শনিবার || ২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ৭ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৩রা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
সুনামির মতো বন্যায় লিবিয়ায় অন্তত ২৩০০ মানুষের মৃত্যু, নিখোঁজ ১০ হাজার
প্রকাশিতঃ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধ, ২:৪১ অপরাহ্ণ । পঠিত হয়েছে ১৯৭ বার।
লিবিয়ায় সুনামির মতো বন্যায় সাগরে ভেসে যাওয়া মানুষকে উদ্ধার করতে রীতিমত লড়াই করতে হচ্ছে উদ্ধারকারী দলগুলোকে।
বন্যায় দেশটির সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ডেরনা শহরের অ্যাম্বুলেন্স কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অন্তত ২৩০০ মানুষ মারা গেছে এই বন্যায়।
শহরের দুটি বাঁধ ও চারটি সেতু ধ্বসে গেছে এবং এর ফলে রোববার ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েলে ভেসে গেছে শহরের বড় একটি অংশ।
রেড ক্রিসেন্ট বলছে প্রায় ১০ হাজার মানুষ এখনো নিখোঁজ আছে এবং মৃত্যুর সংখ্যাও আরও বাড়তে পারে।
কিছু উদ্ধার তৎপরতা সেখানে শুরু হয়েছে, যাতে এগিয়ে এসেছে মিশরও। তবে লিবিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এ তৎপরতা কিছু বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশটি এখন দুটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে বিভক্ত হয়ে আছে।
যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইরান, ইটালি, কাতার এবং তুরস্কসহ কিছু দেশ জানিয়েছে প্রয়োজনীয় সহায়তা করতে তারাও প্রস্তুত আছে।
এর মধ্যে মাত্র আগেরদিন মরক্কোর মধ্যাঞ্চলে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পে দুই হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে বলে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জানিয়েছে মরক্কোর রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন।
পানিতে ভেসে যাচ্ছে গাড়ি
লিবিয়ায় রোববার অন্ধকারের মধ্যেই করা ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে শহরের রাস্তায় বন্যার পানিতে ভেসে যাচ্ছে বহু গাড়ী।
অনেক মানুষের সাগরের পানিতে ভেসে যাওয়ার কষ্টকর ঘটনার পাশাপাশি অনেকে আবার নিজেকে রক্ষার জন্য অবস্থান নিয়েছেন নিজ নিজ বাসা বাড়ির ছাদে।
লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে নিয়ন্ত্রিত সরকারের হয়ে বলছিলেন হিশাম চোকিওয়াত, “যা দেখেছি তাতে আমি হতবাক। এটা ছিলো সুনামির মতো।”
বিবিসিকে তিনি জানিয়েছেন, ডেরনা শহরের দক্ষিণে একটি বাঁধ ধ্বসে যাওয়ায় শহরের বড় অংশ সাগরের পানিতে তলিয়ে গেছে।
“একটি বড় এলাকায় ধ্বংস হয়ে গেছে। বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এর সংখ্যা প্রতি ঘণ্টায় বাড়ছে”।
আলি দেবিয়াহ নামে একজন বলছিলেন, মৃতদেহ উদ্ধারেও হিমশিম খেতে হচ্ছে উদ্ধারকারীদের। তবে নৌবাহিনী ও ডুবুরীরা সাগর থেকে মৃতদেহগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করছে।
বায়দা শহরের সাহায্যকর্মী কাসিম আল কাতানি বিবিসিকে বলেছেন, শহরের প্রধান সড়কগুলো ব্যাপক ক্ষতির শিকার হওয়ায় উদ্ধারকারীদের ডেরনা শহরে পৌঁছানোটাই কঠিন ছিলো।
তবে, কেন বন্যায় এমন ভয়াবহ বিপর্যয় হলো তা নিয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেছেন, প্রায় আড়াই বিলিয়ন লিবিয়ান দিনার (৫১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) ডেরনা এবং পূর্বাঞ্চলীয় শহর বেনগাজীতে বাঁধ পুনর্নির্মাণের জন্য দেয়া হবে।
সৌশা, আল মারজ এবং মিসরাতা শহরও রোববারের ঝড়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পানি প্রকৌশল বিশেষজ্ঞরা বিবিসিকে জানিয়েছেন শহরের ১২ কিলোমিটার দুরে আপার ড্যামই হয়তো প্রথমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরে দ্বিতীয় বাঁধ আর পানির তোড় সামলাতে পারেনি, যা ডেরনা শহর সংলগ্ন এলাকা।
“প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম যে এটা ভারী বৃষ্টিপাত। কিন্তু পরে মধ্যরাতের দিকে বড় ধরণের বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই এবং এই বিস্ফোরণ ছিলো বাঁধ এলাকায়,” রাজা সাশি নামে একজন বলছিলেন বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে।
তিনি তার স্ত্রী এবং শিশু কন্যাসহ প্রাণে বেঁচেছেন।
তিউনিসিয়া ভিত্তিক লিবিয়ার সাংবাদিক নৌরা এলজেরবি বিবিসিকে বলেছেন, ডেরনায় তার ৩৫ জন স্বজনের সবাই বেঁচে আছেন।
“ঘর পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু আমার পরিবারের সবাই পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাবার আগেই বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। তারা এখন নিরাপদ,” বলছিলেন তিনি।
উদ্ধারকর্মী কাসিম আল কাতানি বলছিলেন, ডেরনা শহরে এখন বিশুদ্ধ পানি নেই এবং ঔষধ সরবরাহেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
তিনি জানান যে ডেরনার একমাত্র হাসপাতালটি এখন আর রোগী নিতে পারছে না।
“সাতশরও বেশি মৃতদেহ পড়ে আছে হাসপাতালটিতে”।
তেল সমৃদ্ধ দেশ লিবিয়া ২০১১ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফীর মৃত্যুর পর থেকেই রাজনৈতিক সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
এর একটি সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃত, যা রাজধানী ত্রিপোলি ভিত্তিক। আরেকটি সরকার পূর্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে।
লিবিয়ার সাংবাদিক আব্দুলকাদের আসাদ বলেছেন এ বিভ্রান্তির কারণেও উদ্ধার তৎপরতায় সমস্যা হচ্ছে।
“অনেকেই সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন কিন্তু সাহায্য আসছে না,” বিবিসিকে বলছিলেন তিনি। “কোন উদ্ধারকারী দল নেই। লিবিয়াতে এখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উদ্ধার কর্মীও নেই। সবকিছুই বার বছরের যুদ্ধে শেষ হয়ে গেছে”।
তবে এই বিভাজন সত্ত্বেও ত্রিপোলি ভিত্তিক সরকার একটি বিমানে ১৪ টন ঔষধ, মৃতদেহ বহনের জন্য ব্যাগ ও ৮০ জনেরও বেশি চিকিৎসক ও প্যারামেডিক পাঠিয়েছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে তারা পাঁচ হাজার পরিবারের জন্য খাবার পাঠিয়েছে।
ডেরনা শহরটি বেনগাজীর আড়াইশ কিলোমিটার পূর্বদিকে।
গাদ্দাফীর পতনের পর এই শহরটি ছিলো ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের একটি ঘাঁটি।
পরে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা এলএনএ তাদের বিতাড়ণ করে। এই এলএনএ পূর্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণকারী প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ জেনারেল খালিফা হাফতারের প্রতি অনুগত।
প্রভাবশালী এই জেনারেল বলেছেন বন্যার কারণে হওয়া ক্ষয়ক্ষতি তারা নিরূপণ করছেন।
লিবিয়ার আল ওয়াসাত নিউজ ওয়েবসাইট বলছেন বহু বছর ধরে ডেরনা শহরের রাস্তাঘাটর পুনর্নির্মাণ বা সংস্কার না হওয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা এতো বেশি হয়েছে।