শুক্রবার || ২৩শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ৮ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৪ঠা জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ পদ্ধতি কী এবং কীভাবে কাজ করে
ক্যাটাগরি: আন্তর্জাতিক, প্রকাশিতঃ ৪ নভেম্বর ২০২৪, সোম, ১১:২৪ অপরাহ্ণ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য ভোট নেওয়া হবে পাঁচই নভেম্বর। কিন্তু যে প্রার্থী সবথেকে বেশি ভোট পাবেন, তিনিই যে জয়ী হবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই।
এর কারণ হল ভোটাররা সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন না। ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ নামে এক পদ্ধতিতে হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।
‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ কী?
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা যখন নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেবেন, বেশিরভাগই হয় ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমালা হ্যারিস অথবা রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দেবেন।
তবে এদের দুজনের মধ্যে কে জয়ী হবেন, সেটা ভোটারদের দেওয়া ভোটে সরাসরি নির্ধারিত হবে না। জাতীয় স্তরের নির্বাচনি লড়াইয়ের বদলে জয়ী-পরাজিত নির্ধারিত হবে একেকটি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনি লড়াইয়ের মাধ্যমে।
যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের একটিতে জয়ী হওয়ার অর্থ একজন প্রার্থী সেই অঙ্গরাজ্যের সবকটি ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ ভোট পেয়ে যাবেন।
ইলেকটোরাল কলেজের মোট ভোটের সংখ্যা ৫৩৮।
মাইন ও নেব্রাসকা এই দুটো অঙ্গরাজ্য বাদে বাকি সবগুলো রাজ্যের ইলেকটোরাল ভোট যোগ দিলে যে প্রার্থী ২৭০টি বা তারও বেশি ভোট পাবেন তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন।
সেই প্রার্থীর রানিং মেট হয়ে যাবেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট।
পপুলার ভোট কম পেয়েও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জর্জ ডাব্লিউ বুশ।ছবির উৎস,Getty Images
ছবির ক্যাপশান,পপুলার ভোট কম পেয়েও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জর্জ ডাব্লিউ বুশ।
কীভাবে কাজ করে ইলেক্টোরাল কলেজ?
প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের বেশ কয়েকটি করে ইলেক্টোরাল ভোট থাকে, যা ওই অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যার মোটামুটিভাবে সমানুপাতিক হয়।
ক্যালিফোর্নিয়ার হাতে সর্বাধিক ৫৪টি, এবং ভায়োমিং, আলাস্কা এবং নর্থ ডাকোটা (এবং ওয়াশিংটন ডিসি)-র মতো যেসব অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যা খুবই কম, তাদের হাতে অন্তত তিনটি ইলেক্টোরাল ভোট আছে।
সাধারণত অঙ্গরাজ্যগুলি তাদের হাতে থাকা ইলেক্টোরাল ভোট সেই প্রার্থীকেই দেয়, যিনি ওই অঙ্গরাজ্যের ভোটারদের সরাসরি ভোটে জয়ী হয়েছেন।
ধরা যাক, টেক্সাসে একজন প্রার্থী ভোটারদের সরাসরি ভোটের ৫০.১% পেয়েছেন, তাকে ওই অঙ্গরাজ্যের হাতে থাকা ৪০টি ইলেক্টোরাল ভোটের সবগুলিই সেই প্রার্থী পেয়ে যাবেন। একটি অঙ্গরাজ্যে জয়ের ব্যবধান যদি বিরাট হয়ও, তাহলেও জয়ী প্রার্থী অতগুলি ইলেক্টোরাল ভোটই পাবেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনের থেকে প্রায় ৩০ লক্ষ কম ভোট পেয়েও মিসেস ক্লিনটনকে পরাজিত করেছিলেন। জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০০০ সালে আল গোরকে পরাজিত করেছিলেন, যদিও সাধারণ ভোটে তার জয়ের ব্যবধান ছিল পাঁচ লক্ষেরও বেশি।
ওই দুজনের আগে আর মাত্র তিনজন সাধারণ ভোটে না জিতেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তবে সেগুলি উনবিংশ শতাব্দীর ঘটনা।
একেক রাজ্যের হাতে একেক সংখ্যক ভোট থাকার কারণে প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী প্রচারণার ব্যাপারে এমনভাবে ছক তৈরি করেন যেখানে তারা বেশি ভোট আছে এমন রাজ্যগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ কেন বলা হয়?
‘কলেজ’ শব্দটির অর্থ এখানে সেই ব্যক্তিদের বোঝানো হয়, যারা একটি অঙ্গরাজ্যের ভোট দেওয়ার অধিকারী।
‘ইলেকটোরাল কলেজ’ হচ্ছে কর্মকর্তাদের একটি প্যানেল, যাদের ‘ইলেকটরস্’ বলা হয়। এরা এক কথায় নির্বাচক মণ্ডলী। প্রতি চার বছর পর পর এটি গঠন করা হয়, এবং এরাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্টকে বাছাই করেন।
কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্বের অনুপাতে প্রতিটি স্টেটের ইলেকটরসের সংখ্যা নির্ধারিত হয়: যা নির্ধারিত হয় স্টেটে সেনেটরের সংখ্যা (প্রত্যেক স্টেটে দুইজন) এবং প্রতিনিধি পরিষদে প্রতিনিধির (যা জনসংখ্যার অনুপাতে) যোগফল মিলে।
ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি অনুযায়ী যেসব রাজ্যে জনসংখ্যা বেশি, সেসব রাজ্যে ইলেকটোরাল ভোটও বেশি।
এই প্রথা শুধুমাত্র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্যই ব্যবহৃত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অন্য সব নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় সরাসরি মানুষের ভোটেই।
তবে প্রকৃতপক্ষে দেখা যায় যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়েছেন যে প্রার্থী, তাকেই নির্বাচকরা তারা ভোট দিয়েছেন।
অঙ্গরাজ্য থেকে যাকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে, তার বিরুদ্ধে যদি কোনও নির্বাচক ভোট দেন, তাকে ‘ফেইথলেস’ বা অবিশ্বাসী বলা হয়।
এর আগে ২০১৬ সালের নির্বাচনে এভাবেই সাতটি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট দেওয়া হয়েছিল, তবে নির্বাচনের ফলাফলে তার কোনও প্রভাব পড়ে নি।
ইলেক্টোরাল ভোটে ‘টাই’ হলে কী হবে?
কোনও ক্ষেত্রে যদি স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা কেউ না পান, সেক্ষেত্রে মার্কিন আইন সভার নিম্ন-কক্ষ হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভস ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে।
এই ঘটনা মাত্র একবারই হয়েছে ১৮২৪ সালে। ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট চারজন প্রার্থীর মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ায় কেউই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পান নি।
বর্তমানে অবশ্য রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টি দুটির যে আধিপত্য রয়েছে, তাতে ওইরকম ঘটনা হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই।
ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি কেন বেছে নেওয়া হয়েছিল?
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান যখন লেখা হচ্ছিল ১৭৮৭ সালে, তখন বিশালাকার দেশটিতে যোগাযোগের অভাবের ফলে জাতীয় স্তরে সাধারণ মানুষের ভোট নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা কার্যত অসম্ভব ছিল।
সংবিধান রচয়িতারা তখন ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন।
সংবিধান প্রনেতারা ১৭৮৭ সালে সংবিধান রচনার সময় কংগ্রেস এবং জনগণের সরাসরি ভোটে (পপুলার ভোট) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুটো ধারণাই বাতিল করে দেন।
তাদের যুক্তি ছিল পপুলার ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে লোকেরা তাদের স্থানীয় প্রার্থীকে ভোট দেবে এবং তার ফলে বড় রাজ্যগুলো আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে।
ছোট ছোট রাজ্যগুলো এই ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতিকে সমর্থন করে কারণ এর ফলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এই পদ্ধতির পক্ষ নেয় কারণ সেসময় এসব রাজ্যে দাসের সংখ্যা ছিলো অনেক। দাসদের ভোটাধিকার না থাকা সত্ত্বেও আদম শুমারিতে তাদের গণনা করা হতো।
এছাড়াও সংবিধান রচয়িতারা চাননি যে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বসে শুধু আইন প্রণেতারা দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করুক।
• ছোট অঙ্গরাজ্যগুলি প্রার্থীদের কাছে গুরুত্ব পায়।
• প্রার্থীদের গোটা দেশ ঘোরার দরকার হয় না, গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্যগুলির প্রতি নজর দিলেই চলে
• পুনর্গণনা সহজতর, কারণ কর্মকর্তারা একটি অঙ্গরাজ্যের সমস্যা সহজে চিহ্নিত করতে পারেন।
অসুবিধা:
• সাধারণ মানুষের ভোটে জয়ী প্রার্থীও নির্বাচনে হেরে জেতে পারেন
• ভোটারদের একাংশের মনে হয় যে তাদের ব্যক্তিগত ভোটের কোনও মূল্য নেই
• কথিত ‘সুইং স্টেট’গুলির হাতে অত্যধিক ক্ষমতা
বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্যই প্রতিটা নির্বাচনে ধারাবাহিকভাবে একই দলকে ভোট দিয়ে আসে।
আমেরিকান নির্বাচনে রিপাবলিকান দুর্গ বলে পরিচিত এই অঙ্গরাজ্যগুলোকে বলা হয় ‘রেড স্টেট’ বা ‘লাল রাজ্য’ আর ডেমোক্র্যাটদের প্রাধান্য পাওয়া স্টেটগুলোকে বলা হয় ‘ব্লু স্টেট’ বা ‘নীল রাজ্য’।
ফলে এসব রাজ্য নিয়ে প্রার্থীদের খুব বেশি চিন্তা করতে হয় না বা মনোযোগ দিতে হয় না।
কিন্তু হাতে গোণা কিছু অঙ্গরাজ্য আছে যে রাজ্যগুলোর ভোট, প্রার্থীদের কারণে যে কোন শিবিরে যেতে পারে।
ফলে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা নির্দিষ্ট কিছু ‘সুইং স্টেট’এর দিকে নজর দেন যেখানে ভোট কোন পার্টির পক্ষে যাবে, তা নির্দিষ্ট করে বোঝা যায় না।
এগুলোই হল আমেরিকান নির্বাচনের ব্যাটলগ্রাউন্ড বা নির্বাচনী রণক্ষেত্র। এগুলোকেই অনেকে বলে থাকে ‘বেগুনি রাজ্য’।
প্রার্থীদের কাছে এসব অঙ্গরাজ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। যেগুলোকে বলা হয় ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট বা নির্বাচনী রণক্ষেত্র।
আর এই অঙ্গরাজ্যগুলোর ভোটই শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় জয় পরাজয়ের মূল চাবিকাঠি। এই রাজ্যগুলোতেই হয় মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, মিশিগান, নেভাডা, পেনসিলভেনিয়া এবং উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যগুলি ২০১৬ সালে এভাবেই ‘ব্যাটল-গ্রাউন্ড স্টেট’ হয়ে উঠেছিল।
প্রত্যেক নির্বাচনের সময় দেখা গেছে যেসব রাজ্যের ভোট বেশি, প্রার্থীরা সেসব রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারণার পেছনে অনেক বেশি সময় ও অর্থ ব্যয় করে থাকেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা ২০২০ সালে ‘ভুয়া নির্বাচক’ শব্দটার সঙ্গে প্রথমবার পরিচিত হন। সেই বছর ট্রাম্প-পন্থী রিপাবলিকানরা সাতটি অঙ্গরাজ্যে নিজেদের ‘নির্বাচক’ তৈরি করেছিলেন যাতে নির্বাচনের ফলাফল ঘুরিয়ে দেওয়া যায়।
কোনও ক্ষেত্রে তারা সরকারি নথির মতো দেখতে ভুয়া নথি বানিয়ে, তাতে সই করিয়ে ১৪ই ডিসেম্বর অঙ্গরাজ্যের রাজধানীগুলিতে হাজির হয়ে যান। ওইদিনই গোটা দেশের নির্বাচকরা আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট দিয়েছিলেন।
এই জালিয়াতিতে যারা অংশ নিয়েছিলেন, তাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তদন্ত এখনও চলছে।
নির্বাচনের উল্লেখযোগ্য কিছু ইতিহাস
২০১৬: রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ৩০৬টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, যদিও তিনি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে প্রায় ৩০ লাখ ভোট কম পেয়েছিলেন।
২০০০: রিপাবলিকান প্রার্থী জর্জ ডাব্লিউ বুশ ২৭১টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, যদিও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী অ্যাল গোর পাঁচ লাখ ৪০ হাজার ভোট বেশি পেয়েছিলেন।
১৮৮৮: রিপাবলিকান প্রার্থী বেঞ্জামিন হ্যারিসন ২৩৩টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, যদিও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড এক লাখ ৪৫৬ ভোট বেশি পেয়েছিলেন।
১৮৭৬: রিপাবলিকান রাদারফোর্ড বি হেইজ ১৮৫টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, কিন্তু ডেমোক্র্যাট প্রার্থী স্যামুয়েল জে টিলডেন দুই লাখ ৬৪ হাজার ভোট বেশি পেয়েছিলেন।
১৮২৪: ইলেকটোরাল কলেজ চারজন প্রার্থীর পক্ষে বিভক্ত হয়ে হাউজ জন কুইন্সি অ্যাডামসকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে, যদিও এন্ড্রু জ্যাকসন তার চেয়েও বেশি পপুলার ইলেকটোরাল ভোট পেয়েছিলেন।