রবিবার || ২৫শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ১০ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৬ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
গানা হতে জার্মানি: একটি হারানো মানিব্যাগের মালিককে খুঁজে বের করার কাহিনী
প্রকাশিতঃ ১০ এপ্রিল ২০২৩, সোম, ১:০৩ পূর্বাহ্ণ । পঠিত হয়েছে ২৮৪ বার।
কালো, রঙচটা, প্লাস্টিকের মানিব্যাগটি পাওয়া গিয়েছিল ইতালির ল্যাম্পাডুসা দ্বীপে। গানা থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার পথ সাথে নিয়ে এসে এটি মনে হয় ফেলে দেয়া হয়েছিল।
মানিব্যাগটি খোলার পর ভেতরে অনেক কিছুর সঙ্গে একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স। রিচার্ড ওপুকু’র যে ছবিটি লাইসেন্সের এক কোনায়, সেটি থেকে তিনি যেন সরাসরি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
লাইসেন্সটি আরও অনেক ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের সঙ্গে খুঁজে পাওয়া গেছে ল্যাম্পাডুসা দ্বীপের তীরে। ছোট্ট নৌকায় বিপদজনক পথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যারা ইউরোপে আসার চেষ্টা করে, তাদের অনেকে এসে নামে এই জায়গাটায়। এখানেই তারা তাদের জিনিসপত্রে ফেলে রেখে যায়।
এই মানিব্যাগটি পাওয়া গিয়েছিল কয়েক বছর আগে। এটি দেখে আমার বেশ কৌতূহল জেগে উঠলো- এই ড্রাইভিং লাইসেন্সের পেছনে যে গল্প লুকিয়ে আছে, আমার সেটি জানার ইচ্ছে হলো।
কী ঘটেছিল রিচার্ড ওকুপুর ভাগ্যে?
এই ওয়ালেটটি ছিল একটি সংগ্রহশালায়, যেখানে এরকম আরও বহু মানুষের বিষাদময় স্মৃতির ব্যক্তিগত জিনিসপত্র। প্রতিবছর যে হাজার হাজার মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে উত্তর আফ্রিকা থেকে ল্যাম্পাডুসায় আসার চেষ্টা করে, তাদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য গড়ে উঠেছে এটি।
লাইফজ্যাকেট, রান্নার হাঁড়ি, পানির বোতল, কপালে লাগানো যায় এমন টর্চ, ক্যাসেট টেপ- তাকের ওপর এবং দেয়ালে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা এরকম অনেক জিনিস। ল্যাম্পাডুসার বন্দরের ঠিক পাশেই এই মিউজিয়াম।
একদল স্বেচ্ছাসেবী ২০০৯ সাল হতে মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহার্য এসব জিনিস সংগ্রহ করে চলেছে।
“অনেকে তাদের সঙ্গে মাটিও নিয়ে আসে। তাদের নিজেদের দেশ থেকে”, একটি ছোট প্লাস্টিকের প্যাকেট তুলে ধরে বলছিলেন গিয়াকোমো এসফারলাজো। যারা এই মিউজিয়ামটি গড়ে তুলেছে তিনি তাদের একজন।
“এরকম ছোট ছোট কিছু প্যাকেট আমরা খুঁজে পেয়েছি। আফ্রিকায় নিজের দেশের সঙ্গে তাদের বন্ধন কত গভীর ছিল, এগুলো তার প্রমাণ”, বলছিলেন তিনি।
গিয়াকোমো এরপর একটি বড় ফোল্ডার বের করলেন। ভেতরে অনেক ছবি, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, চিঠি। এর মধ্যেই ছিল মি. ওপুকুর কাগজপত্র।
ল্যাম্পাডুসা আসলে ইউরোপের চাইতে আফ্রিকার অনেক কাছাকাছি- এই ছোট্ট জেলে এবং পর্যটন দ্বীপে থাকে ছয় হাজারের মতো মানুষ। নতুন জীবনের সন্ধানে যারা সাগর পাড়ি দেয়, তাদের জন্য এই দ্বীপ বহু কাল ধরেই গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য প্রথম পা ফেলার জায়গা।
প্রতি বছর ইউরোপে যাওয়ার জন্য হাজার হাজার মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথ পাড়ি দেয়। কেবল এবছরের মার্চ মাসেই তিন হাজারের বেশি মানুষ ল্যাম্পাডুসায় এসে পৌঁছেছে। গত বছরের একই সময় যত মানুষ এসেছিল, এবার তার দ্বিগুণ।
ভূমধ্যসাগরের এই অংশটি হয়ে উঠেছে অভিবাসীদের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর রুট। ২০১৪ সাল হতে এই রুটে মারা গেছে বা নিখোঁজ হয়েছে বিশ হাজারের বেশি মানুষ।
কিন্তু মি. ওপুকু হয়তো তাদের একজন, যারা বেঁচে গেছেন। কীভাবে তিনি এতদূর এসে পৌঁছেছিলেন, সেটি জানার জন্য আমি গানায় ফিরে যাই।
গানার মধ্যাঞ্চলীয় ব্রং আহা-ফোতে যাই আমি। এখান থেকে বহু মানুষ অভিবাসী হতে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমায়। এদের অনেকেই যেহেতু উত্তর দিকে যায়, তাদের কারও সাথে হয়তো কখনো মি. ওটুকুর দেখা হয়েছে।
ব্রং আহা-ফোর বহু পরিবার এখনো পর্যন্ত অপেক্ষায় আছে তাদের স্বজনদের খবরের জন্য, যদিও তারা বাড়ি ছেড়ে গেছে বহু বছর আগে।
রিটা ওহেনেওয়াহর স্বামী ২০১৬ সালে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল ২০১৬ সালে। লিবিয়ার উপকূল হতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ল্যাম্পাডুসায় যাবে, সেটাই ছিল তার পরিকল্পনা। সেবছরের ডিসেম্বরে লিবিয়া থেকে তিনি শেষবার রিটাকে ফোন করেছিলেন। তারপর আর কোন খবর পাননি।
“ও আমাকে বলেছিল গানায় যাচ্ছে এমন এক ব্যক্তির মাধ্যমে আমাকে কিছু টাকা পাঠাবে। বলেছিল সেই সাথে একটি মোবাইল ফোন এবং ছেলে-মেয়েদের জন্য কিছু কাপড়-চোপড়ও পাঠাবে। সেদিন সকালে এবং বিকেলে দুবার কথা হয়। তারপর আজ পর্যন্ত আর ওর সঙ্গে কথা হয়নি।”
রিটার মতোই মি. ওপুকুর জন্যও নিশ্চয়ই একজন স্ত্রী বা কোন আত্মীয় অপেক্ষায় আছেন।
গানার রাজধানী আক্রায় গিয়ে আমি মি. ওপুকুর ব্যাপারে আরও তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তথ্য সুরক্ষা আইন এবং নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আমার সেই চেষ্টা বারে বারে আটকে যাওয়ায় আমাকে হতাশ হতে হয়।
তবে অনেক চেষ্টার পর অবশেষে একটা পথ খুঁজে পাওয়া গেল।
গানার ইমিগ্রেশন সার্ভিসের ‘ডকুমেন্ট ফ্রড এক্সপার্টাইজ সার্ভিসের’ ফ্রাংক আপ্রন্টি আমাকে এই ড্রাইভিং লাইসেন্সটি যার, তার এক আত্মীয়ের একটি ফোন নম্বর খুঁজে দিলেন।
এটি ছিল মি. ওপুকুর বোনের নাম্বার। তার মাধ্যমে যোগাযোগ হলো মি. ওপুকুর সঙ্গে। তিনি জানালেন, তিনি জীবিত এবং এখন জার্মানিতে বসবাস করছেন।
আমি যখন মি. ওপুকুকে ফোন করে জানালেন, ল্যাম্পাডুসায় আমি তার ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছি, তখন তিনি খুবই অবাক হলেন।
তিনি এটি হারিয়েছিলেন ২০১১ সালে, এবং কখনো ভাবেননি যে এটি আবার খুঁজে পাওয়া যাবে। আমি যতক্ষণ পর্যন্ত না এই ড্রাইভিং লাইসেন্স তার সঙ্গে শেয়ার করেছি, ততক্ষণ তো তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে এটি আমার কাছে আছে। শেষ পর্যন্ত আমি জার্মানিতে যাই তার সঙ্গে দেখা করতে।
জার্মানির উত্তরাঞ্চলীয় শহর ব্রেমেনে শীতের এক বরফ-শীতল সকালে তিনি আমাকে স্বাগত জানালেন তার এক বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টে। ৪০ বছর বয়সী মি. ওপুকু এখন কাজ করেন ফর্কলিফট ট্রাক ড্রাইভার হিসেবে।
গানায় থাকার সময় তিনি কিছুদিন অবৈধ স্বর্ণখনি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছিলেন। গানায় এদের বলা হয় গ্যালামসি। তিনি এই কাজ করেছিলেন ইউরোপে পাড়ি জমানোর খরচ জোগাড়ের জন্য। খনিতে যেসব সুড়ঙ্গে তারা কাজ করতেন সেগুলো বেশ বিপদজনক, মাঝে-মধ্যেই ধসে পড়ে।
এরপর ২০০৯ সালে যখন তিনি ইউরোপে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি জানতেন এই পথে কত রকমের ঝুঁকি আছে। কিন্তু তার মনে হয়েছিল, গানায় তার কাজে যে ঝুঁকি, তার চেয়ে এই ঝুঁকি সেরকম বেশি কিছু নয়।
তিনি ইউরোপের যাওয়ার পথে বিভিন্ন অঞ্চল হয়ে গেছেন, যাতে চলার পথেও কিছু অর্থ উপার্জন করা যায়।
প্রথমে তিনি যান বেনিনের কোটোনুতে। সেখান থেকে নাইজেরিয়ার লাগোসে। এই বিশাল শহরে তিনি একটি স্কুটারে করে যাত্রী পরিবহনের কাজ করতেন। লাগোস থেকে তিনি আবার কোটোনুতে ফিরে আসেন, এরপর যান প্রতিবেশী দেশ নিজেরে। সেখানে দু মাস কাজ করেন একটি রেস্টুরেন্টে।
তবে তার জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষা ছিল একটি গাড়িতে করে নিজের থেকে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে লিবিয়ায় যাওয়া। তিনি তার গাড়ি ভাড়া মিটিয়েছিলেন নাইজেরিয়া এবং নিজেরে কাজ করে উপার্জন করা অর্থ দিয়ে।
তিনি খুব অবাক হয়েছিলেন, যেখানে কোন রাস্তার নিশানা পর্যন্ত নেই, সেখানে ড্রাইভার কিভাবে কোন পথে যেতে হবে, তা বুঝতে পারছিল, সেটা দেখে।
“পথে মাঝে মধ্যে আমরা এরকম অনেক গ্রুপের দেখা পেয়েছিল, ড্রাইভার সহ যাদের ৩৫ জনই মারা গেছে”, বলছিলেন তিনি। এরা হয়তো পিপাসায় মারা গেছে, তবে তিনি নিশ্চিত নন।
“এই পথে যাত্রার সময় পানি স্বর্ণ বা হিরের চেয়েও মূল্যবান। পুরো দিনে আপনি হয়তো একবার বা দুবার পানি পান করতে পারবেন, সেটাও একটা ছোট্ট চুমুক।”
চাডের সীমান্তে দুর্বৃত্তরা তাদের গাড়ি আটকালো, এরপর যাত্রীদের সব কাপড়চোপড় আর অর্থ লুট করলো।
মি. ওপুকু তার টাকা শরীরে লুকিয়ে রেখেছিলেন, ফলে সেটা ওরা খুঁজে পায়নি।
লিবিয়া পৌঁছানোর পর আবার বিপদ শুরু হলো। তাকে অপহরণ করা হলো মুক্তিপণের জন্য। অর্থের জন্য তিনি কোন আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না বলে তাকে সাংঘাতিক মারধোর করা হলো। শেষ পর্যন্ত লিবিয়ার এক নারী, যিনি একজন গৃহকর্মী খুঁজছিলেন তিনি মুক্তিপণ দিয়ে মি. ওপুকুকে নিয়ে গেলেন।
এরপর ২০১১ সালে, গানা ছেড়ে আসার দুবছর পর লিবিয়ায় যখন মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়, তখন মি. ওপুকু ত্রিপলি থেকে একটি নৌকায় উঠলেন ল্যাম্পাডুসা যাওয়ার জন্য।
কিন্তু ভূমধ্যসাগরের মাঝে এসে তাদের নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। মি. ওপুকু এবং তার সহযাত্রীদের তখন নির্ভর করতে হচ্ছিল বাতাসের ওপর। শেষ পর্যন্ত ইতালির কোস্টগার্ড এসে তাদের উদ্ধার করে।
তাদের নৌকায় যখন ল্যাম্পাডুসার তীরে এসে থামলো, তখন তিনি তার ড্রাইভিং লাইসেন্সটি হারিয়ে ফেলেন।
সেখানে তাদের প্রথমে একটি শিবিরে রাখা হয়। এরপর সিসিলিতে অভিবাসীদের এক কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। তার পরিকল্পনা ছিলো সেখান থেকে জার্মানিতে যাবেন। কারণ নিজের দেশের অন্য মানুষদের কাছে শুনেছিলেন, জার্মানি থাকার জন্য একটা ভালো দেশ।
তবে ইতালিতে থাকা অবস্থাতেই তিনি আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেন। প্রথমে তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়। পরে অবশ্য তিনি ইউরোপে থাকার অনুমতি পান। কারণ তখন জাতিসংঘ ইতালিকে বলেছিল, যারা ২০১১ সালে লিবিয়ার অশান্ত পরিস্থিতির সময় পালিয়ে এসেছিল, তাদের যেন এক বছর থাকার অনুমতি দেয়া হয়। তবে মি. ওকুপুর এসব তথ্য আমার পক্ষে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
“আমি যেন দোজখের ভেতর দিয়ে শেষ পর্যন্ত এখানে এসে পৌঁছেছি”, বলছিলেন তিনি।
মি. ওপুকু ভেবেছিলেন, ইউরোপে তার একটা সহজ জীবন হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা ঘটেনি।
“আফ্রিকায় থাকার সময় আমার ধারণা ছিল, ইউরোপে সহজে অর্থ অর্জন করা যায়। কিন্তু ব্যাপারটা সেরকম নয়। এখানে আপনাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়।
তবে নিজের দেশে আমার তো টিকে থাকার মতো কিছুই ছিল না। কাজেই আমি বলবো, এখানে থাকতে পেরে আমি কৃতজ্ঞ”, বলছেন মি. ওপুকু।—বিবিসি নিউজ