রবিবার || ২৫শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ১০ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৬ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
সাংবাদিকদের কেন জেলে যেতে হয়?
প্রকাশিতঃ ৩০ মার্চ ২০২৩, বৃহঃ, ১০:৩৩ অপরাহ্ণ । পঠিত হয়েছে ৮১ বার।
বাংলাদেশে একটি সংবাদ প্রকাশে অসঙ্গতিকে কেন্দ্র করে একজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের ঘটনাকে ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে আইনের অপব্যবহার হিসেবে দেখছেন গণমাধ্যমকর্মী এবং সংশ্লিষ্টরা।
২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ হওয়ার পর থেকেই এর অপব্যহারের সুযোগ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। আবার এটি আলোচনায় এসেছে ২৯শে মার্চ ভোরে সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে নিজ বাসা থেকে মধ্যরাতে আটকের ঘটনায়।
দ্রব্যমূল্য নিয়ে দৈনিক প্রথম আলোতে করা একটি প্রতিবেদনে শিরোনাম এবং ছবির মধ্যে অসঙ্গতির জের ধরে সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে সাদা পোশাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
পরে জানানো হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা একটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সাংবাদিকদের পেশাগত ভুল-ত্রুটি শুধরানোর জন্য অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন উপায় আছে। আইনী পন্থায় এগোতে চাইলেও আছে একাধিক আইন। এমনকি একটি বিশেষ বিচারিক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
কিন্তু সব বাদ দিয়ে বারবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহারকে ‘উদ্দেশ্যমূলক’ বলে মনে করছেন গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা।
‘দেশে কি আর কোন আইন নেই’
গত ২৯ মার্চ ভোরে নিজ বাসা থেকে তুলে নেয়ার প্রায় ৩০ ঘণ্টা পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা একটি মামলায় সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে আদালতে তোলা হয়।
এসময়ের মধ্যে কারা তাকে তুলে নিয়েছিল, কোথায় রাখা হয়েছিল সে সম্পর্কে কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
একইদিন বিকেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হওয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানান।
সাদা পোশাকে তুলে নেয়ায় কোন বাহিনী শামসুজ্জামানকে নিয়ে নিয়েছিল সেই বিষয়টিও স্পষ্ট ছিল না।
ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখার উদ্দেশ্যেই এরকম ঘোলাটে ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরির কারণ হিসেবে দেখছেন স্বাধীন গণমাধ্যম নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা।
সাংবাদিকদের মধ্যে ভীতি স্থাপন এবং সেলফ সেন্সরশিপের উদ্দেশ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করা হচ্ছে বলে মনে করেন সম্পাদক পরিষদের সভাপতি এবং ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম।
ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন করার পর থেকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা মামলার সিংভাগের বেশি ডিজিটাল আইনে করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই আইনের ২০টি ধারাতে সাংবাদিকদের শাস্তি দেয়া যায়, যার মধ্যে ১৪টিই অজামিনযোগ্য।
একজন সাংবাদিক এমন কী গুরুতর অপরাধ করতে পারে যে জামিন দেয়াটাও গ্রহণযোগ্য না, প্রশ্ন তোলেন মি. আনাম।
“অন্য কোন আইন ব্যবহার না করে সরকার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কেবল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার কারণ স্পষ্ট” বলে মন্তব্য করেন মিস্টার আনাম।
“দেশে কি আর কোন আইন নাই – এই প্রশ্নটা আমরা করছি”, বলেন তিনি।
একই মত তথ্য ও মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন আর্টিকেল ১৯- এর দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সালের।
শাস্তি দেয়ার জন্য না, বরং ভয় দেখানোর জন্য এই আইনের ব্যবহার হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক দেশের জন্য এই আইন খুবই লজ্জাষ্কর।
ভুল সংশোধন, প্রেস কাউন্সিল ও সাংবাদিকতা
গণমাধ্যমের প্রকাশিত কোন প্রতিবেদন নিয়ে আপত্তি থাকলে ওই গণমাধ্যমে তা লিখিতভাবে পাঠানো হলে দ্রুততার সঙ্গে সঠিকভাবে ছাপানো ‘শত বছরের প্রথা’ হিসেবে উল্লেখ করেন মিস্টার আনাম।
এছাড়াও গণমাধ্যমকর্মী বা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের জন্য রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘প্রেস কাউন্সিল’।
১৯৭৪ সালে প্রেস কাউন্সিল আইন প্রণয়ন করা হয়। আইনটি প্রণয়নের পাঁচ বছর পর ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় প্রেস কাউন্সিল।
এই আইনে প্রেস কাউন্সিলকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা অভিযোগের বিচার করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
কোন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কেউ পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকতা-নীতির পরিপন্থী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ করতে চাইলে তিনি প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ বা মামলা দায়ের করতে পারেন।
কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের পর থেকে যেকোনো অভিযোগে সরাসরি মামলা ও সাংবাদিকদের তুলে নেয়ার মতো ঘটনা প্রায়শই ঘটছে।
সরকারের অবস্থানকেই এর কারণ হিসেবে দেখছেন মিস্টার ফয়সাল।
তিনি বলেন, “যারা ক্ষমতায় আছেন তারা নাজুক পরিস্থিতিতে আছেন। ফলে যে আত্মবিশ্বাস একটা সরকারের থাকা দরকার, সেই আত্মবিশ্বাস সরকারের আছে বলে মনে হচ্ছে না। সেখানেই সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শক্তির যতদূর অপব্যবহার সম্ভব, তা করছে”।
এবিষয়ে মিস্টার আনাম বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পুরোটাই সাংঘাতিক জঘন্য আইন। এটার বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার ছিলাম, এখনো আছি। এই আইন সংশোধন না, একেবারে বাতিল করা উচিৎ”।
‘রাতে গ্রেফতার, হদিস নেই’ – এভাবে উদ্বেগ সৃষ্টি কেন?
২০২০ সালের ১১ই মার্চ পুরনো ঢাকার চকবাজার এলাকায় বাসা থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হন সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল।
এর ঠিক একদিন আগে ১০ই মার্চ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্য সাংবাদিক কাজলের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন।
নিখোঁজ হওয়ার ৫৩ দিন পর গভীর রাতে যশোরে বেনাপোল সীমান্তের একটি মাঠ থেকে তাকে উদ্ধার করার কথা জানায় পুলিশ।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রথমেই গ্রেফতার না করে ডেকে পাঠানোর নির্দেশনার কথা একাধিকবার গণমাধ্যমকে বলেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
কিন্তু সর্বশেষ সাংবাদিক শামসুজ্জামানের ঘটনাতেও মামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাকে তুলে নেয়া হয়। বিশেষ করে রাতের বেলা বাসার ভেতরে সাদা পোশাকে ঢুকে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসহ তাকে নিয়ে যাওয়া হয়।
মিস্টার আনাম বলেন, “ডিএসএ হবার পর থেকে আমরা অনেকবার বলেছি যে একটা সেলফ সেন্সরশিপের ছায়া সাংবাদিকতায় পড়েছে”।
“সাংবাদিকের মধ্যে ভীতি স্থাপন করা হচ্ছে যে কোর্টে গিয়ে কী হবে সেটা পরের কথা। প্রথমে কিন্তু তোমাকে এমন এক পরিস্থিতিতে ফেলবো যেখানে কি না সাংঘাতিক একটা ভয় তোমার মধ্যে ঢোকে”, বলেন তিনি।
তার সঙ্গে একমত গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে কাজ করা মিস্টার ফয়সাল।
তিনি বলেন, “নিরাপত্তাহীনতার ভয় দেখিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে সেলফ সেন্সরশিপ তৈরি করা হচ্ছে”।
একে আতঙ্ক ছড়ানোর বিশেষ কায়দা বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে দায়ের করা মামলাগুলো নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এই আইনে অভিযুক্তদের মধ্যে রাজনীতিবিদদের পরেই সবচেয়ে বেশি রয়েছে সাংবাদিক।
আর্টিকেল ১৯- এর মিডিয়া মনিটরিংয়ে পাওয়া তথ্যমতে, ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করা ৫৭৩ টি মামলার ১১০টি করা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে, যাতে ২২৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে ৫৪ জনকে।
এ ধরনের আইন ক্ষমতা চর্চার হাতিয়ার বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরি গায়েন।
তিনি বলেন, সাংবাদিকতায় যদি ভুল হয় আর সেটা যদি শুধরে নেয়া হয় এবং দুঃখপ্রকাশ করা হয় সেটা যথেষ্ট।
কিন্তু এভাবে সাংবাদিককে তুলে নেয়া দুঃখজনক ও উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সরকার কী বলছে?
ডিউজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা সাংবাদিকের বিরুদ্ধে নয় বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলে উল্লেখ করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
৩০শে মার্চ দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী একথা বলেন।
তিনি বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মামলায় যখন তথ্য দেয়া হবে তখন পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে এটির মেরিট নির্ধারনের জন্য আগে সেলে পাঠানো হবে এবং তা পরীক্ষার পর মামলা নেওয়া হবে।
সাংবাদিক শামসুজ্জামানের মামলার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত মামলার বিবরণীতে ছিল। সেক্ষেত্রে পরীক্ষার জন্য পাঠানোর প্রয়োজন পড়ে না বলে এই মামলা গ্রহণ করা হয়েছে।
এসময় জনগণকে সত্য তথ্য প্রকাশ করলে কোনো মতেই এই সরকার সাংবাদিকদের বাধা দেবে না বলেও মন্তব্য করেন আইনমন্ত্রী।
এছাড়া কিছু মামলায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।