শুক্রবার || ২৩শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ৮ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৪ঠা জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
বাংলাদেশে ট্রায়াল হওয়া ডেঙ্গু টিকা সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে
প্রকাশিতঃ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শুক্র, ১২:২৫ পূর্বাহ্ণ । পঠিত হয়েছে ২৬৮ বার।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানের আবিষ্কার করা ডেঙ্গু টিকা সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ‘সফলভাবে ট্রায়াল বা পরীক্ষা’ চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বা আইসিডিডিআরবি’র বিজ্ঞানীরা। এই টিকার একটি ডোজ ডেঙ্গুর চারটি ধরণের জন্যই কার্যকর হবে বলে দেখতে পেয়েছেন তারা।
এই টিকা আবিষ্কার করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথ বা এনআইএইচ। টিকার নাম দেয়া হয়েছে টিভি০০৫।
ডেঙ্গু টিকার দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা ছিল বাংলাদেশে। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্মন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের লার্নার কলেজ অব মেডিসিন এবং বাংলাদেশের আইসিডিডিআরবি’র গবেষকরা যৌথভাবে এটি পরিচালনা করেছেন।
আইসিডিডিআরবি গবেষকরা দাবি করছেন, ডেঙ্গু টিকার দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা শেষে দেখা গেছে এটি শিশু ও প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে প্রয়োগের জন্য নিরাপদ এবং এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে সক্ষম।
ডেঙ্গুর মোট চারটি ধরণ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ এবং ডেন-৪।
গবেষকরা বলছেন, ডেঙ্গু টিকা আবিষ্কারে এনআইএইচ প্রথম প্রতিষ্ঠান নয়। এর আগে সানোফি ফার্মাসিউটিক্যালস এবং তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যালস ডেঙ্গু টিকা তৈরি করেছে।
“সানোফির টিকা তিনটি আলাদা ডোজের এবং এটি নয় বছরের কম বয়সী শিশু, যারা আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে, তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। আর তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যালসের ডেঙ্গুর টিকা দুই ডোজের। এই টিকা ডেঙ্গুর মাত্র একটি ধরণের ক্ষেত্রেই কার্যকর,” বিবিসি বাংলাকে বলেন আইসিডিডিআরবি’র জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী রাশিদুল হক।
যেভাবে পরীক্ষা করা হয়
২০০৯ সাল থেকে এই ডেঙ্গু টিকার পরীক্ষা শুরু হয়। বাংলাদেশে এই টিকা পরীক্ষার সাথে যুক্ত দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন আইসিডিডিআরবি’র জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী রাশিদুল হক।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে পরীক্ষার আগে এটি যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রাজিলেও পরীক্ষা চালানো হয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল- দুই দেশেই প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের দুটি পরীক্ষাই করা হয়েছে।
এ বিষয়ে রাশিদুল হক বলেন, যে কোন টিকা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়- এই তিনটি ধাপে পরীক্ষা করা হয়। প্রথম ধাপে দেখা হয় যে, ওই টিকাটি মানুষের দেহে প্রয়োগের জন্য নিরাপদ কী না।
দ্বিতীয় ধাপে দেখা হয়, টিকার নিরাপত্তা এবং এটির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির সক্ষমতা।দেরীতে হাসপাতালে যাওয়ার কারণে ডেঙ্গুতে অনেকের মৃত্যু হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা।
আর তৃতীয় ধাপের পরীক্ষায় এটির কার্যকারিতা দেখা হয়। অর্থাৎ যে জনগোষ্ঠীর উপর টিকা পরীক্ষা করা হয় তাদের মধ্যে কেউ আবারো ওই রোগটি দ্বারা আক্রান্ত হয় কী না।
মি. হক জানিয়েছেন, বাংলাদেশে যে ট্রায়াল বা পরীক্ষাটি হলো সেটি শুধুমাত্র দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা। অর্থাৎ এই টিকার নিরাপত্তা এবং এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে পারে কী না সে বিষয়টিই পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে।
ট্রায়ালের আওতায় ২০১৫ সাল থেকে ক্লিনিকাল ট্রায়াল ও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ে পড়াশুনাসহ পরীক্ষা চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতা তৈরি করা হয়। পরে ২০১৬ সাল থেকে ডেঙ্গুর টিকার দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা শুরু হয়।
এর আওতায় গবেষকরা এক থেকে ৪৯ বছর বয়সী ১৯২ জনের উপর টিকা প্রয়োগ করেন এবং পরবর্তী তিন বছর ধরে তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করেন। পরীক্ষায় অংশ নেয়া সবাই স্বেচ্ছায় এতে অংশ নেন এবং তাদেরকে দৈব-চয়ন পদ্ধতিতে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচন করা হয় বলে জানানো হয়।
টিকা দেয়ার আগে এদের সবাইকে চারটি আলাদা ভাগে ভাগ করা হয়। এদের মধ্যে এর আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন এমন ব্যক্তিও ছিলেন।
তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা ভারতে করা হবে। চলতি মাস থেকে এই পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে বলেও জানান আইসিডিডিআরবি এর বিজ্ঞানী রাশিদুল হক।
যা পেয়েছেন গবেষকরা
আইসিডিডিআরবি’র গবেষকরা বলছেন, তিন বছর ধরে পর্যবেক্ষণের পর তারা দেখতে পান যে, বেশিরভাগ স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে ডেঙ্গুর চারটি ধরণের বিরুদ্ধেই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। যারা এর আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন তাদের দেহে এই অ্যান্টিবডির মাত্রাও বেশি পাওয়া গেছে।
একই সাথে যাদের দেহে টিকা প্রয়োগ করার পর তিন বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে, তাদের কেউই এই সময়ের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হননি।
আইসিডিডিআরবি এর বিজ্ঞানী রাশিদুল হক বলেন, এরই মধ্যে এই টিকা আমেরিকা এবং ব্রাজিলের জনগোষ্ঠীর উপর পরীক্ষা করা হয়েছে। এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই প্রথম পরীক্ষা করা হলো।
“আমাদের পপুলেশনেও আমরা দেখলাম যে এটা সেফ(নিরাপদ) এবং ইমিউনোজেনিক(রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে),” বলেন তিনি।
যাদের উপর টিকা প্রয়োগ করা হয়েছিল তাদের মধ্যে গুরুতর কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। কারো কারো শরীরে র্যাশ, জ্বর, মাথাব্যথার মতো উপসর্গ ছিল।
“২৮% ভ্যাক্সিনেটেডের মধ্যে আমরা র্যাশ পাইছি, যে র্যাশ তিন-চার দিনের মধ্যে মিলায় গেছে।”
তিনি বলেন, “র্যাশ হওয়াটা ভাল। আমরা বলি যখন এই ভাক্সিনটা দেয়া হলো তার মানে সেটা রিঅ্যাক্ট করতেছে বডিতে, এবং অ্যান্টিবডি প্রডিউস করতেছে। আমরা একে বলি হ্যাপি র্যাশ।”
মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে কাউকে হাসপাতালে ভর্তি করার মতো অবস্থা দেখা যায়নি।
এটি যেভাবে আলাদা
ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে বাজারে এরই মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠানের দুটি আলাদা টিকা রয়েছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হচ্ছে সানোফি ফার্মাসিউটিক্যালসের ডেংভ্যাক্সিয়া নামে একটি টিকা।
রাশিদুল হক বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বলা হয়েছে, ৯ বছরের বেশি বয়সীদের এই টিকা দেয়া যাবে। তবে তার জন্য অবশ্যই আগে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত না হলে এই টিকা দেয়া যাবে না।
তিনি বলেন, এই টিকাটির মোট তিনটি ডোজ ছয় মাস পর পর নিতে হয়। শিশুদের উপর এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি হয়। এছাড়া এই টিকা বেশ ব্যয়বহুলও বটে।
সেদিক থেকে দেখতে গেলে টিভি০০৫ নামে নতুন এই ডেঙ্গু টিকার মাত্র একটি ডোজই সব ধরণের ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে কার্যকর হবে। আলাদা আলাদা ডোজ নেয়ার দরকার হবে না। শিশুসহ সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ডেঙ্গু আক্রান্ত না হলেও এই টিকা নেয়া যাবে। আর অন্য টিকার তুলনায় এটি সস্তা হবে।
“যেহেতু ভ্যাক্সিনটা সিঙ্গেল ডোজ এবং আমাদের ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টে উৎপাদিত হচ্ছে, অবশ্যই এটি অনেক সস্তা হবে। ক্যাপাবিলিটি থাকলে আমাদের দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোও এটি তৈরি করতে পারবে।”
কবে বাজারে আসবে?
আইসিডিডিআরবি’র জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী রাশিদুল হক বলেন, টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর সেখানে যদি আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যায়, তারপর সেটি উৎপাদনের জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা-এফডিএ, বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর-বিজিডিএ ইত্যাদির মতো সংস্থা এই অনুমোদন দিয়ে থাকে।
মি. হক বলেন, টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরণের কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পাওয়ার পর সেগুলো বাজারে আসে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে টিকার অনুমোদন নেয়া হয় সাধারণত। তবে টিকা তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার পর সরকার চাইলে উৎপাদনের অনুমোদন দিতে পারে বলে জানা যায়।
বিজ্ঞানী রাশিদুল হক বলেন, সিরাম ইন্সটিটিউট, পেনেসিয়া বায়োটেক এবং ই-বায়োলজিক্যালসহ ভারতের কমপক্ষে তিনটি ওষুধ কোম্পানি এরইমধ্যে ডেঙ্গুর টিকা উৎপাদনের জন্য টিকা আবিষ্কারক সংস্থা ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথের কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়েছে।
এরই মধ্যে পেনেসিয়া বায়োটেক ডেঙ্গু টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এবং সেটি এ বছরই শুরু হবে। এই পরীক্ষার অর্থায়ন করছে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ-আইসিএমআর।
“ওদের ট্রায়ালের পর হয়তো ভ্যাক্সিনটা ওরা ওদের ওখানে রেজিস্ট্রেশন করবে এবং ওদের সরকার যেভাবে মনে করে সেভাবে এটাকে ইউজ করবে।”
রাশিদুল হক বলেন, বাজারে থাকা অন্য দুটি টিকার তুলনায় ডেঙ্গুর এই টিকা নিয়ে তারা বেশ আশাবাদী। তারা মনে করছেন, এটি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারবে।
ভারতের টিকাটির তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা সফল হলে আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে এটি বাজারে আসবে বলে ধারণা করছেন তিনি।
কত বড় সাফল্য?
ডেঙ্গুর অনেক রকম টিকাই সারা বিশ্বে পরীক্ষা করা হচ্ছে। আর এই টিকাটি যেহেতু ডেঙ্গুর সব ধরণের উপর কার্যকর হবে বলে বলা হচ্ছে, তাই এটি একটি বড় সাফল্য হতে পারে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মোশতাক হোসেন বলেন, এই টিকাটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেহেতু আগে কখনো ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে কী না তার উপর নির্ভরশীল নয়, তাই এটি একটি ইতিবাচক দিক।
বাংলাদেশে যে পরীক্ষাটি হলো সেটি দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষা এবং এটির পরীক্ষার আরো ধাপ বাকি রয়েছে। খতিয়ে দেখার মতো আরো অনেক বিষয় রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
এই টিকা বাজারে আসলে সেটি ডেঙ্গুর প্রতিরোধে ভালো একটি উপায় হতে পারে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
কারণ এরই মধ্যে বাংলাদেশে ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এ বছরই এক হাজারের মতো মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় দুই লাখ মানুষ।