শনিবার || ২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ৭ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৩রা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
বার্বির প্রকৃত অনুপ্রেরণা এবং পুতুলটি নিয়ে ছয়টি অজানা তথ্য
প্রকাশিতঃ ৩০ আগস্ট ২০২৩, বুধ, ২:৫২ অপরাহ্ণ । পঠিত হয়েছে ৩৭৬ বার।
রুথ হ্যান্ডলার এবং তার স্বামী এলিয়ট ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় এক গ্যারেজের ভেতর কারখানায় ‘ম্যাটেল’ নামে একটি খেলনার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।
রুথ হ্যান্ডলার যে ‘বার্বি ডল’ তৈরি করেছিলেন, সেটি ১৯৫৯ সালে বাজারে আনা হয়েছিল।
দুই হাজার দুই সালে মৃত্যুর পাঁচ বছর আগে, রুথ এবং তার মেয়ে বারবারা আইকনিক পুতুলের বিস্তারিত সম্পর্কে বিবিসির সাথে কথা বলেছিলেন।
সাক্ষাৎকারটি ১৯৯৭ সালে নেয়া হয়েছিল বিবিসি উইটনেস হিস্ট্রি সিরিজের একটি পর্বের জন্য, তার ভিত্তিতেই এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
১. পুতুলের প্রাপ্তবয়স্ক নারীর অবয়ব নিয়ে সমালোচনা
রুথ হ্যান্ডলার ১৯৫৯ সালের নয়ই মার্চ নিজের বানানো বার্বি পুতুলটি নিউ ইয়র্কের এক খেলনার মেলায় নিয়ে যান।
বিবিসিকে তিনি বলেন, গ্রাহকদের অর্ধেক সেই পুতুলটা খুব একটা পছন্দ করেননি।
পুরুষেরা ভেবেছিল যে নারীরা নারী শরীরের মেয়ে পুতুল – যার স্তন আছে, যার সরু কোমর এবং চিকন গোড়ালি আছে, যে পুতুল আবেদনময়ী এবং প্রাপ্তবয়স্ক চেহারার- তেমন পুতুল কিনবে না।
তারা আরো ভেবেছিল তাদের স্ত্রীরা এ ধরণের পুতুল রাখতে চাইবে না এবং এ পুতুল অপ্রাপ্তবয়স্ক বা শিশুদের জন্য উপযুক্ত নয়।
কিন্তু তাদের এসব ধারণা ভুল ছিল।
অন্যদিকে, নারীরা খুব দ্রুতই পুতুলটি পছন্দ করেছিল এবং পুতুল কেনার জন্য তাদের মধ্যে এক রকম কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল।
মেলায় দোকানের তাকে যতবার এই পুতুল তোলা হচ্ছিল, সাথে সাথেই শেলফ খালি করে দিচ্ছিল নারী ক্রেতারা।
নিজেদের মেয়ে শিশুদের জন্যই হুড়োহুড়ি করে পুতুল কিনছিলেন তারা।
২. নতুন মডেলের পুতুল তৈরির ধারণা কিভাবে পেয়েছিলেন হ্যান্ডলার
রুথ হ্যান্ডলার বিবিসিকে বলেছিলেন, তার নিজের মেয়ে বার্বি কাগজের পুতুল নিয়ে খেলতেন।
“এবং বছরের পর বছর ধরে আমি তাকে তার বন্ধুদের সাথে কাগজের পুতুল দিয়ে খেলতে দেখেছি। তারা যেভাবে খেলত এবং পুতুলগুলোকে যেভাবে তারা উপস্থাপন করত তাতে আমি মুগ্ধ হতাম বরাবর।”
তখন আমি আমার স্বামী এলিয়ট এবং ম্যাটেলের ডিজাইনারদের কাছে এই আইডিয়া প্রকাশ করি, কিন্তু তাদের কারও কাছ থেকে কোনও ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাইনি আমি।
তাই পরে আস্তে আস্তে সেসব ধারণা বাদ দিলাম।
৩.বার্বির অনুপ্রেরণা এসেছে সুইজারল্যান্ডের একটি দোকান থেকে
রুথ হ্যান্ডলার একবার সুইজারল্যান্ডে তার পরিবারের সাথে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন, সেখানে তখন একটি এপিফেনি দেখতে পান তিনি। এপিফেনি হল পুতুলের মাধ্যমে বিভিন্ন পরিস্থিতির বর্ণনা দেয়া।
রুথ হ্যান্ডলার বলেন, “ আমরা একটা খেলনার দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সেখানকার জানালায় বেশ কয়েকটি প্রাপ্তবয়স্ক গড়নের পুতুল সাজানো অবস্থায় দেখতে পাই।”
একেকটি পুতুল ছিল প্রায় ১২ ইঞ্চি লম্বা, এবং সেটি একটি দড়ির দোলনায় বসা অবস্থায় ছিল, তার পরনে ছিল ইউরোপীয় স্কি পোশাক।
“এমন বিভিন্ন ধরণের ইউরোপীয় স্কি পোশাকে তার মতো আরও ছয়-সাতটি পুতুল ছিল, যা আমার এবং আমার মেয়ে বারবারার কাছে ভীষণ সুন্দর লেগেছিল,” বলেন রুথ হ্যান্ডলার।
জার্মানির একটি জাতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত কমিক স্ট্রিপ চরিত্রের নাম ছিল লিলি। সেই লিলির উপর ভিত্তি করে পুতুলগুলো বানানো হয়েছিল।
শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক উভয় বাজার ধরতে পুতুলটিকে বাজারে ছাড়া হয়েছিল, এবং এর প্রচারণা চালানো হয় অনেকটা এভাবে ‘উই আর ক্রেজি: দ্য ডলস নেইম ওয়াজ লিলি’।
তখন রুথ হ্যান্ডলারের মেয়ে বারবারার বয়স ১৫ বছর হলেও, সে ওই পুতুল নিতে চায়।
রুথ হ্যান্ডলার বলেন, এতোগুলো পুতুলের মধ্যে বারবারা যে ঠিক কোনটি চায়, তা ঠিক করতে পারছিলো না, কারণ প্রত্যেকটা স্কি পোশাক আলাদা ছিল।
তখন আমি বিক্রেতাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আমি কি এক স্টাইলের পুতুলটি কিনে আরেক পুতুলের পরনের পোশাকটি কিনতে পারি?”
এই কথা শুনে, সেই বিক্রয়কর্মী আমার দিকে পাগলের মত তাকিয়ে ছিল। শুধুমাত্র একজন পাগল আমেরিকানই এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে।
ওই বিক্রয়কর্মী বলেছিলেন “না, আপনি যদি ওই পোশাকটি চান তবে আপনাকে ওই পুতুলটি কিনতে হবে। আর আপনি যদি এই সাজসরঞ্জাম চান, তাহলে এই পুতুল কিনুন।”
ততক্ষণে দোকানের আলো নেভানো শুরু হয়ে যায়।
এভাবেই একটি পুতুলের সাথে পোশাকের পুরো ওয়ারড্রব বিক্রির আইডিয়ার জন্ম হয়েছিল।
৪. কীভাবে আসল ‘বার্বি’ পুতুল জগতে সাড়া ফেলেছিল
রুথ হ্যান্ডলারের মেয়ে বারবারার নামে বার্বি পুতুলের নাম রেখেছিলেন। বার্বি পুতুলটি যখন প্রথম বাজারে আসে তখন বারবারার বয়স ছিল ১৮ বছর।
রুথ হ্যান্ডলার বলেন, লোকে যখন জানলো যে বারবারাই বার্বি ডলের অনুপ্রেরণা, বিষয়টি সে একেবারেই পছন্দ করেনি। মানুষজন তখন তাকে খুব বিরক্ত করতে শুরু করে।
এ নিয়ে বারবারা হ্যান্ডলার বিবিসিকে বলেছিলেন, “বিষয়টা খুব অদ্ভুত ছিল। লোকজন আমার কাছে এসে অটোগ্রাফ চাইত।”
যখন তারা এসে বলতো “ওহ, তুমিই আসল বার্বি! আমি বিষয়টা একদমই বুঝতে পারতাম না, কারণ বার্বি নামটা শুধুমাত্র পুতুলটির নাম হিসেবে রাখা ছিল। কিন্তু অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে এই পুতুলের মডেল আমি।
এবং পুতুলটি যেহেতু আমার মতো দেখতে এবং আমার হয়ত পুতুল হওয়ার কথা। কিন্তু বিষয়টি তো তা নয়।”
৫. পুরুষ পুতুল কেইনের যৌনাঙ্গ বিতর্ক
রুথ এবং এলিয়ট ১৯৬১ সালে ‘কেইন’ নামে একটি পুরুষ পুতুল বাজারে আনেন। ‘কেইন’ ছিল ওই দম্পতির পুত্র সন্তানের নাম। কিন্তু শুরুতে এ পুতুলটির নকশা নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়েছিল।
রুথ হ্যান্ডলার বলেন, কেইন নামে পুতুলটি নকশা করার সময় আমরা সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে এটি যৌনাঙ্গ ছাড়াই তৈরি করা হবে।
ডিজাইনারদের সাথে আমার এমনটাই আলোচনা হয়েছে।
ডিজাইন টিম মানে পুতুলের নকশাকারী দলে থাকা পুরুষদের মনে হয়েছিল যে কেইনের যৌনাঙ্গ থাকা উচিত নয়।
তবে এটা নিয়ে আমি এতটা নিশ্চিত ছিলাম না।
আমি যৌনাঙ্গের জায়গায় সামান্য উঁচু দলা করে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম, এবং সেজন্য পুরোটা বছর ধরে আমাদের নানা রকম ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
৬. নারীবাদীদের সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন বার্বি স্রষ্টা
রুথ হ্যান্ডলার বলেন, তারা সচেতনভাবে বার্বিকে খুব সুন্দর অবয়বের না করার চেষ্টা করেছিলেন।
“আমরা পুতুলটিকে খুব সুন্দর চেহারার বানানোর ব্যাপারে আগ্রহী ছিলাম না, কারণ আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে মেয়েরা যদি এই পুতুলের উপর নিজের প্রতিফলন দেখতে চায় বা পুতুলের মতো হতে চায়, সেটা ভালো হবে না।”
আমরা চাই না যে একটি ছোট মেয়ে বার্বির সৌন্দর্যের সামনে নিজের প্রকৃত সৌন্দর্য নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগুক।
বার্বি পুতুলের কার্টুন চরিত্র তৈরি করা হয় যখন সেসময় নারীবাদীসহ বিভিন্ন মহলের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন রুথ হ্যান্ডলার এবং তার প্রতিষ্ঠান।
তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন, এ ব্যবসার কারণে আমি আমার সন্তানদের সময় দিতে পারতাম না।
সন্তানদের থেকে বিচ্ছিন্ন একজন মা হওয়ার কারণে আমার ভেতরে প্রচণ্ড অপরাধবোধ কাজ করতো। তবে তারপরও আমাকে কাজ চালিয়ে যেতে হয়েছে, কারণ তখন সেখানে কোনও পেশাদার নারী ছিলেন না।
অন্য নারীরাও জানতেন না কিভাবে আমার সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে হয়।
আমরা যদি বাইরে বের হতাম, আমি নিজেকে সবসময় পুরুষদের সাথে বসে ব্যবসা নিয়ে কথা বলতে দেখতাম।
তবে নারীবাদীদের নানা সমালোচনা সত্ত্বেও, রুথ হ্যান্ডলার একজন পেশাদার নারীর মতো তার কাজ চালিয়ে গেছেন।—বিবিসি নিউজ