শনিবার || ২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ৭ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৩রা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
বাংলাদেশকে ৫০ মিলিয়ন ডলার শোধ, শ্রীলংকা কীভাবে দেড় বছরে ঘুরে দাঁড়ালো
প্রকাশিতঃ ২৪ আগস্ট ২০২৩, বৃহঃ, ১১:৩০ অপরাহ্ণ । পঠিত হয়েছে ২৬৮ বার।
কারেন্সি সোয়াপ পদ্ধতির আওতায় ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বাংলাদেশের কাছ থেকে এক বছর মেয়াদের জন্য ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিলো শ্রীলংকা। চার কিস্তিতে নেয়া সে ঋণের ৫০ মিলিয়ন ডলার চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশকে ফেরত দিয়েছে দেশটি।
এবং এ মাসের শেষ নাগাদ আরও ৫০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করার কথা রয়েছে।
অথচ মাত্র দেড় বছর আগেই ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে প্রায় দেউলিয়া হবার জেরে দেশটিতে ব্যাপক রাজনৈতিক সহিংসতা হয়েছিলো, যার পরিণতিতে শ্রীলংকার সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়েছিলো। দেশ ছাড়তে হয়েছিলো দেশটির তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গোটাভায়া রাজাপাকশাকেও।
বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত হয়ে সেসময় এমন অবস্থা হয়েছিলো যে দেশটি আর আমদানি ব্যয় মেটাতে পারছিলো না। এর জের ধরে খাদ্য, ঔষধসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছিলো।
তেলের স্টেশনে দীর্ঘ লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছিলো মানুষকে।
সে পরিস্থিতি এখন অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে দেশটি এবং জমে উঠতে শুরু করেছে শ্রীলংকার অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি পর্যটন খাত এবং জ্যামিতিক হারে বাড়ছে দেশটির রেমিট্যান্স।
এবং এ ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে শিগগিরই দেশটির অর্থনীতি আরও শক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে বলে মনে করছে বিশ্লেষকরা।
কলম্বোর সাংবাদিক শিহার আনিজ বলছেন, দোকানে পণ্য নেই কিংবা কিছু থাকলেও অনেক দাম, অথচ মানুষের দীর্ঘ লাইন- বিপর্যয়কর সেই অবস্থা এখন আর নেই শ্রীলংকায়। বরং দাম বেশি থাকলেও নিত্য দরকারি সব কিছুর সরবরাহ এখন বাজারে স্বাভাবিক হয়েছে।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, “পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এ অর্থে যে কোথাও এখন আর লম্বা লাইন দেখা যায় না। দাম বেশি হলেও বাজারে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে। জীবনযাত্রাও সে সময়ের তুলনায় অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে।”
যদিও তিনি মনে করেন সংকট থেকে এখনো পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারেনি দেশটি। বরং প্রকৃত অবস্থা কী হয় সেটা বোঝা যাবে, যখন দেশটি বিদেশি ঋণ পরিশোধ করা শুরু করবে।
কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক প্রিয়াংঙ্গা দুনুসিংহে বলছেন সরকারি নীতি আর কিছু ‘অটোমেটিক’ বিষয়ের সমন্বয়েই পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছে শ্রীলংকা।
কী নীতির কারণে ঘুরে দাড়াচ্ছে শ্রীলংকা
মাত্র দেড় বছরের মধ্যে ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশটি যে ঘুরে দাঁড়াতে পারলো তার কারণ হিসেবে দুটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক প্রিয়াংঙ্গা দুনুসিংহে।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছেন, “সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু নীতি পরিস্থিতির উন্নতিতে ভূমিকা রেখেছে। এর ফলে রেমিট্যান্স ও পর্যটনের মতো কিছু ক্ষেত্রে অটোমেটিক রিকাভারি হয়েছে। এ দুটোর সমন্বয়েই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে আরও অনেক দূর যেতে হবে।”
সরকার ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব বাড়িয়েছে, এবং সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করে করজাল বিস্তৃত করেছে – এর ফলও অর্থনীতিতে দেখা যাচ্ছে বলে মনে করেন অধ্যাপক দুনুসিংহে।
“বিভিন্ন ঋণদাতা দেশ এবং আইএমএফ এর মতো সংস্থার সাথে সরকার আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে রপ্তানি বাড়তে শুরু করেছে। রেমিট্যান্স অনেকগুণ বেড়েছে। আবার পর্যটনের মতো খাত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। পাশাপাশি গত বছর বিপুল পরিমাণ দক্ষ ও আধা দক্ষ শ্রমিক বিদেশে গেছে,” বলেন অধ্যাপক দুনুসিংহে।
আগের বছরের তুলনায় এ বছর পর্যটন খাত থেকে শ্রীলংকার আয় বেড়েছে ২৫ শতাংশের বেশি। আর রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ।
অন্যদিকে, সাংবাদিক ও বিশ্লেষক শিহার আনিজ বলছেন সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হলো মুদ্রার অবমূল্যায়ন আর ভর্তুকি কমিয়ে করজাল বিস্তৃত করে রাজস্ব আয় বাড়ানো।
শ্রীলংকার সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছর জুলাই মাসে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি ছিলো ছয় দশমিক তিন শতাংশ। এ সময়ে কমেছে খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি।
অথচ বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের সংকটকালে মূল্যস্ফীতি হয়েছিলো ৪৯ শতাংশের বেশি।
তবে গত দশ মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে মূল্যস্ফীতি কমলেও এখনো বিপুল পরিমাণ দেশী বিদেশী ঋণের ভারে জর্জরিত দেশটি।
মূলত কোভিড মহামারির ধাক্কায় দেশটির পর্যটন খাত ধ্বসে পড়ায় এবং একই সাথে প্রবাসী শ্রীলংকানদের রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেলে ২০২২ সালের শুরুতে ভয়ংকর সমস্যায় পড়ে দেশটি।
সাথে যোগ হয় ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধের কারণে পণ্য আমদানির ব্যয় ব্যাপক ভাবে বেড়ে যায় যা আর দেশটি সামাল দিতে পারেনি।
এ সংকটের জের ধরে নজিরবিহীন গণবিক্ষোভের মুখে ২০২২ সালের ১৩ই জুলাই ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট গোটাভায়া রাজাপাকশা।
এরপর নানা ঘটনার ধারাবাহিকতায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে দেশটির দায়িত্ব নেন।
অধ্যাপক প্রিয়াংঙ্গা দুনুসিংহে মনে করেন, শ্রীলংকা আপাতত পরিস্থিতিকে সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে।
যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিলো
ক্ষমতা গ্রহণের পর কিছু কিছু খাতে সংস্কারের পাশাপাশি আইএমএফের সাথে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের একটি ‘বেইল আউট প্যাকেজ’ নিয়ে আলোচনা শুরু করেন রনিল বিক্রমাসিংহে। চলতি বছরের মার্চে আইএমএফ বোর্ড সেটি অনুমোদন করে।
এরপর খাদ্য মূল্য, বিদ্যুতের দাম সামান্য কমানোর চেষ্টা করে জনজীবন সহজ করার চেষ্টা করে সরকার। এবং এর অংশ হিসেবে ২৩ লাখ অতি দরিদ্র পরিবারকে নগদ অর্থ সহায়তা দেয়া হয়।
সাংবাদিক শিহার আনিজ এবং অধ্যাপক প্রিয়াঙ্গা দুনুসিংহে- দুজনেই বলেছেন যে পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার শুরু থেকেই ব্যয় কমানোর চেষ্টা করেছে ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে।
আবার গত বছর বিদেশে কর্মী পাঠানো অতীতে সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে দেশটির তিন লাখ ১১ হাজারের বেশি মানুষ কাজের জন্য বিদেশে গেছে, যাদের অনেকেই ডাক্তার, প্যারামেডিকেল কিংবা আইটি প্রফেশনাল।
অবশ্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২৩ সালেও জিডিপি হ্রাসের প্রবণতায় থাকবে শ্রীলংকা। তবে ২০২৪ সাল থেকে ধীরে ধীরে এটি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে।
দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেবে ২০২৩ সালের দ্বিতীয় অর্ধে এসে অর্থনীতির ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি হবে।
“সময়মত আমদানি বিষয়ক নীতি পরিবর্তন ছাড়াও অর্থনীতিকে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলো। বিশেষ করে আইএমএফ সমর্থিত সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে শক্ত পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে,” বলছিলেন অধ্যাপক দুনুসিংহে।
তবে এই এক বছরে সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হয়েছে শ্রীলংকার ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে।
চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় সাত শতাংশ। কৃষি খাতও ভালো করতে শুরু করেছে। বিশেষ চা ও রাবার রপ্তানি বেড়েছে।
তবে এর মধ্যেও সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে কোন কোন খাতে কর বাড়ানো আবার কোন খাতে ভর্তুকি কমানোর মতো অজনপ্রিয় পদক্ষেপও নিতে হয়েছে রনিল বিক্রমাসিংহের সরকারকে।
পাশাপাশি সংকট এড়াতে এগিয়ে এসেছিলো বিশ্বব্যাংকও।
চলমান থাকা প্রকল্পগুলো থেকে প্রায় ৩২৫ মিলিয়ন ডলার তারা জরুরি প্রয়োজনের খাতে সরিয়ে নেয়, বিশেষ করে ঔষধ, লিকুইড পেট্রলিয়াম গ্যাস এলপিজি, সার এর মতো পণ্যগুলো যাতে মানুষ সহজে পেতে পারে সেজন্য এমন পদক্ষেপ নেয় সংস্থাটি।
এছাড়া বাজেট সহায়তার অংশ হিসেবেও বৈশ্বিক সংস্থাটি ৭০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে শ্রীলংকার সরকারকে।
অভ্যন্তরীণ ও দেশের বাইরে থেকে শ্রীলংকার এখন মোট ঋণের পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। কোন কোন সংস্থার হিসেবে এই ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলার।
এর মধ্যে ১১ বিলিয়ন ডলারের বেশি শোধ করতে হবে চীন, জাপান এবং ভারতকে। আবার মোট ঋণের মধ্যে ২৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করতে হবে ২০২৭ সালের মধ্যে।
সরকার ঋণ পুনর্বিন্যাসের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশ ও সংস্থাগুলোর সাথে আলোচনা করছে। আলোচনা সফল হলে ঋণ ভার কিছুটা হলেও লাঘব হবে দেশটির।
শিহার আনিজ বলছেন, কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও বিদেশী ঋণ পরিশোধ কার্যক্রম কিন্তু এখনো শুরু হয়নি।
“সেটি যখন শুরু হবে তখন আসলে বোঝা যাবে আমাদের অর্থনীতি কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারলো,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
এর বাইরে পর্যটনকে আরও চাঙ্গা করা আর রেমিট্যান্স আরও বাড়িয়ে নেয়ার পদক্ষেপ নেয়ার কোনো বিকল্প নেই দেশটির হাতে।
তবে দেশটিতে সংস্কার কার্যক্রমের বিরোধিতা করে ইতোমধ্যেই ট্রেড ইউনিয়নগুলো সরকারের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে।
খরচ কমাতে শ্রীলংকান এয়ারলাইন্স, শ্রীলংকা টেলিকম এবং শ্রীলংকান ইনস্যুরেন্স কর্পোরেশনের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে বেসরকারিকরণের যে পরিকল্পনা সরকার নিয়েছে, তার বিরোধিতা কাটিয়ে বাস্তবায়ন করাও হবে বিক্রমাসিংহে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
অন্যদিকে, ভর্তুকি কমানো বা বাদ দেয়ার কারণে বিদ্যুৎসহ কিছু ক্ষেত্রে মানুষের ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। যেমন শুধু বিদ্যুৎ খাতেই ব্যয় বেড়েছে ৬৫ ভাগ, যার ফলে ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে।
আবার কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন ভাতা দিয়ে প্রশাসনিক কার্যক্রম সচল রাখাটাও সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
পরিস্থিতি সামাল দিতে চলতি বছরেও সব মন্ত্রণালয়ের বাজেট ছয় শতাংশ করে কমানো হয়েছে। এছাড়া দেশটির সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যাও কমিয়ে অর্ধেকে আনার পরিকল্পনা করেছে সরকার।
এসব পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত কতটা বাস্তবায়ন করতে পারবে শ্রীলংকা এবং কত দ্রুত অর্থনীতিকে আবার স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারে দেশটি সেটাই এখন দেখার বিষয় ।