রবিবার || ২১শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ৬ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ১লা রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
সাতক্ষীরায় মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদ-াদেশ প্রাপ্ত আসামী সাবেক এমপি খালেক ম-লের মৃত্যু
প্রকাশিতঃ ২১ জুলাই ২০২৩, শুক্র, ১:৩৫ পূর্বাহ্ণ । পঠিত হয়েছে ১৮১ বার।
মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদ-াদেশপ্রাপ্ত আসামী সাতক্ষীরার কুখ্যাত রাজাকার মাওলানা আব্দুল খালেকের মৃত্যু হয়েছে। বৃহষ্পতিবার বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিটে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তিনি জেলা জামায়াতের সাবেক আমীর ও সাবেক সাংসদ।
আব্দুল খালেক ম-ল সাতক্ষীরা সদরের বৈকারী ইউনিয়নের খলিলনগর গ্রামের মৃত লাল চান ম-ল ও দিলজান বিবির ছেলে। তার জন্ম ১৯৪৪ সালের পহেলা আগষ্ট।
১৯৬৫ সালে খালেক ম-ল মাদ্রাসা থেকে কামিল পাস করে সাতক্ষীরা কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ১৯৬৯ সালে ¯œাতক পাস করেন। এ সময় তিনি জামায়াত ইসলামীর তৎকালিন ছাত্র সংগঠণ ইসলামী ছাত্র সংঘের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজ এ মাস্টার্স পাস করেন। ২০০১ সালে তিনি জামায়াত ইসলামের টিকিটে সাতক্ষীরা সদরের সাংসদ নির্বাচিত হন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাড. মোস্তফা নুরুল আলম জানান, ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়কে ঘিরে সিটি কলেজের প্রভাষক ও ছাত্রলীগ নেতা মামুনকে নৃশংসভাবে হত্যা মামলার অন্যতম এজাহার ও চার্জশীটভুক্ত আসামী খালেক ম-ল। এ ছাড়া শহরের ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি হাসপাতালের সামনে নাশকতা সৃষ্টির অভিযোগে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ২/১৪ নং মামলার আসামী ছিলেন তিনি। এ ছাড়া সাতক্ষীরা আদালতে অস্ত্র ও বিষ্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলা সহ কমপক্ষে দুই ডজন মামলা ছিলো তার বিরুদ্ধে।
সাতক্ষীরা কারাগারের জেলার মামুনুর রশীদ জানান, সাতক্ষীরায় মামলা থাকার কারণে খালেক ম-লকে ঢাকা থেকে সাতক্ষীরা কারাগারে আনা হয় কয়েক মাস আগে।
এখানে থাকাকালিন গত ৭ জুলাই মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ জনিত কারণে তাকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ও পরে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে কয়েকদিন পর খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহষ্পতিবার বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিটে তার মৃত্যু হয়। বাবার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তার ছেলে ফারুক হোসেন। আইনি প্রক্রিয়া শেষে তার লাশ শুক্রবার বাড়িতে আনা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, মানবতাবিরোধী অপরাধে ২০২২ সালের ২৪ মার্চ সাতক্ষীরা জেলা জামায়াতের সাবেক আমীর ও সাবেক সাংসদ আব্দুল খালেক ম-লকে মৃত্যুদ- দেয় আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
অভিযোগে বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের সময় খালেক ম-ল সাতক্ষীরার রাজাকার বাহিনীর সংগঠক ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাঁচ ব্যক্তিকে গলা কেটে ও বেয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে হত্যাসহ ছয়টি অভিযোগে তারসহ নয়জনের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরা আদালতে মামলা হয়। ২০০৯ সালের ২ জুলাই মামলাটি দায়ের করেন সদর উপজেলার শিমুলবাড়িয়া গ্রামের শহীদ রুস্তম আলীর ছেলে নজরুল ইসলাম। ২০১৫ সালের ৭ আগষ্ট তদন্তে নামে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সং¯’া। পরে মামলাটি আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর হয়। এরপর ২০১৫ সালের ১৬ জুন খলিলনগর মহিলা মাদ্রাসায় নাশকতা পরিকল্পনা সম্পর্কিত এক গোপন সভা করার সময় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেক ম-ল, রোকনুজ্জামান, আব্দুল্লাহ আল বাকী ও জহিরুল ইসলাম ওরফে টিক্কা খানের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। ২০১৮ সালের ৫ মার্চ আসামীদের বিরুদ্ধে আদালত অভিযোগ গঠণ করে।মামলায় ৩৩ জনের মধ্যে ১৭ জন সাক্ষ্য দেন। ২০২১ সালের ২১ নভেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়। বিচার চলাকালিন সময়ে টিক্কা খান ও বাকী মারা যান। ২০২২ সালের ২৪ মার্চ মানবতাবিরোধী অপরাধে সাতক্ষীরা জেলা জামায়াতের আমীর আব্দুল খালেক ও রোকনুজ্জামানের ফাঁসির আদেশ ঘোষণা করেন তিন সদস্য বিশিষ্ঠ বিচারকম-লীর প্রধান মোঃ শাহীনুর ইসলাম। অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি আবু আহম্মেদ জমাদার ও বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলম। রায়ের সময় আব্দুল খালেক আদালতের কাঠগোড়ায় হাজির ছিলেন। রায়ে বলা হয় খালেক ম-ল সাতক্ষীরার রাজাকার বাহিনীর সংগঠক ও রোকনুজ্জামান সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় তারা সাতক্ষীরার বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধাপরাধ ঘটিয়েছেন তা উঠে এসেছে। খালেক ও রোকনুজ্জামান প্রত্যেককে তিনটি করে অভিযোগে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়। খালেক ম-লের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাড. আব্দুস সোবহান তরফদার। রাষ্ট্রপক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন অ্যাড. রোজিয়া সুলতানা চমন।
যে তিনটি অভিযোগে খালেক ম-লকে মৃত্যুদ-াদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল—
(১) ১৯৭১ সালের ১৮ আগষ্ট বেতনা নদীর পাড়ে আশাশুনির বুধহাটা খেয়াঘাটে আফতাবউদ্দিন ও সিরাজুল ইসলামকে রাজাকার কমা-ার ইসহাক (মৃত) ও তার সহযোগীরা গুলি করে হত্যা করে। পরে স্থানীয় খলিলুর রহমান, মোঃ ইমাম বারী, মোঃ মুজিবুর রহমান ও ইমদাদুল হককে রাজাকার বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র ডায়ম- হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। এ অভিযোগে আব্দুল খালেক মন্ডল ও রোকনুজ্জামান দুজনকেই মৃত্যুদ- দেয় ট্রাইব্যুনাল।
(২) ১৯৭১ সালের ৭ আষাঢ় সকাল ৭টার দিকে আবুল হোসেন ও তার ভাই গোলাম হোসেন নিজেদের বাড়ির পাশে হাল চাষ করছিলেন। সকাল ৯টার দিকে গোলাম হোসেন বাড়িতে পান্তা খেতে এলে আসামী আব্দুল খালেক ম-ল ও জহিরুল ইসলাম টিক্কা খানসহ ১০/১২ জন রাজাকার সদস্য এসে তাকে পাশের পাটখেতে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। গোলাম হোসেনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় আব্দুল খালেককে মৃত্যুদ- দেয় ট্রাইব্যুনাল।
(৩) ১৯৭১ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি কোন এক সময়ে আসামী আব্দুল খালেক ম-ল ও রাজাকার কমা-ার জহিরুল ইসলাম টিক্কা খান একদল পাকিস্তানি সৈন্যকে নিয়ে কয়েকজন গ্রামবাসিকে নিয়ে কাথ-া প্রাইমারী স্কুলে মিটিং করে। সেই মিটিংএ বলা হয়, যারা আওয়ামী লীগ করে ও যারা মুক্তিযুদ্ধে গেছে তারা কাফের। এরপর তারা কাথ-া ও বৈকারী গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া ব্যক্তিদের বাড়িঘর লুট করে জ্বালিয়ে দেয়। সে সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দুই সদস্য মৃত গোলাম রহমানের স্ত্রী আমিরুনকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে রান্না ঘরের পিছনে নিয়ে ধর্ষণ করে। এ ছাড়া বৈকারী গ্রামের ছফুরা খাতুনকে শরিয়তুল্লার ফাঁকা বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করে চার পাকিস্তানি সৈন্য। সদর উপজেলার কাথ-া ও বৈকারী গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরবাড়ি লুটপাট, তাতে অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণে যোগসাজসের দায়ে আব্দুল খালেক ম-লকে মৃত্যুদ- দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।