রবিবার || ২৫শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ১০ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৬ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
চীন ও রাশিয়া মিলে আমেরিকান ডলারের আধিপত্য চ্যালেঞ্জ করতে পারবে?
প্রকাশিতঃ ১৯ এপ্রিল ২০২৩, বুধ, ৫:১৪ অপরাহ্ণ । পঠিত হয়েছে ৭৩ বার।
বিশ্ব জুড়ে বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনে ডলার প্রধান মুদ্রা হলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন এক পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেটি হচ্ছে, আমেরিকান ডলারের আধিপত্য খর্ব করার জন্য সক্রিয় হয়েছে চীন ও রাশিয়া।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়েছে মুদ্রাবাজারে। অনেক দেশ আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের বিকল্প হিসাবে নিজেদের মুদ্রা ব্যবহার করার চেষ্টা করছে।
বর্তমান বিশ্বে ব্যাংকগুলোর মোট রিজার্ভের ৭০ শতাংশই রয়েছে ডলারের দখলে। বড় অর্থনীতির নিজেদের মুদ্রা চালুর এই চেষ্টায় কি ডলারের সেই আধিপত্য কমবে?
বিকল্প খুঁজছে অনেকে
ইউক্রেনে হামলা করার জেরে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর থেকেই তারা ঘোষণা করেছে, গ্যাস বা তেল বিক্রির অর্থ এখন থেকে রুবলে পরিশোধ করতে হবে। এর ফলে বিনিময় মূল্য কমে যাওয়ার বদলে বরং আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে রুবল।
চীন, ভারত ও তুরস্কের মতো বড় অর্থনীতির দেশ রাশিয়া থেকে রুবলে তেল ও গ্যাস কিনছে। এমনকি ইউরোপীয় দেশগুলোও রুবলে রাশিয়াকে অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পর রাশিয়া সবচেয়ে বেশি তেল রপ্তানি করে থাকে।
রাশিয়ার অর্থায়নে বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে, সেটার ঋণ চীনা মুদ্রা ইউয়ানে পরিশোধের ব্যাপারে বাংলাদেশ ও রাশিয়া সম্মত হয়েছে বলে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো বলছে।
ডলারের বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে ইরান, চীন, ব্রাজিল, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সিঙ্গাপুরসহ ১৮টি দেশের সঙ্গে রূপিতে লেনদেনের একটি চুক্তি করেছে ভারত।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সাবেক অর্থনীতিবিদ ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের স্ট্রাটেজিস্ট ডেভিড উ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তর্জাতিক বিনিময় মুদ্রা হিসাবে ডলার নিয়ে অনেক দেশ ভাবতে শুরু করেছে।‘’
‘’রাশিয়া ডলারের বদলে রুবলে লেনদেনের চেষ্টা করছে। চীনও বৈদেশিক বাণিজ্যে ইউয়ান ব্যবহারের চেষ্টা করছে, কারণ তারাও চিন্তা করতে শুরু করেছে, কোনদিন যদি তাদের অবস্থা রাশিয়ার মতো হয়, তখন কী হবে? ফলে কোন কোন অনেক দেশ নিজেদের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্যে ডলারের বিকল্প ব্যবহারের চেষ্টা করছে।‘’
গত মার্চ মাসে ব্রাজিল ও চীন একটি যুক্তি করেছে, যে চুক্তির বলে দুই দেশের বাণিজ্যের লেনদেন নিষ্পত্তিতে পরস্পরের মুদ্রা ব্যবহার করা হবে।
ইরান, ভেনেজুয়েলা ও রাশিয়ার মতো দেশগুলোয় পণ্য বিনিময়ে ২০১৮ সালে সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এক্সচেঞ্জ স্থাপন করেছে চীন, যেখানে তারা রেনমিনবি বা আরএনবিতে লেনদেন করছে।
বাংলাদেশে পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’একটা প্রচেষ্টা চলছে, সেটা বলা যায়। কিন্তু সত্যিকারে ডলারের জন্য কোন হুমকি তৈরি করবে কিনা, তা বুঝতে হলে আরও অপেক্ষা করতে হবে।‘’
বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, অগাস্ট মাসে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে গঠিত জোট ব্রিকসের যে সম্মেলন রয়েছে, সেখানে ডলারের বিকল্প মুদ্রায় লেনদেনের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেতে পারে।
ডলার আধিপত্য হারাবে?
বর্তমান বিশ্বে রিজার্ভ মুদ্রা হিসাবে ডলারের অবস্থান প্রায় ৭০ শতাংশ। এরপরেই রয়েছে ইউরো, পাউন্ড, অস্ট্রেলিয়ার বা কানাডার মুদ্রা, ইয়েনের অবস্থান। বাংলাদেশের আমদানির ৮৫ শতাংশ আর রপ্তানির ৯৭ শতাংশ ডলার ব্যবহার করে করা হয়।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের ২০১৯ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বিভিন্ন দেশের মধ্যে সরাসরি নিজেদের মুদ্রা বিনিময়ের সুযোগ থাকলে ঝুঁকি এবং বাণিজ্যিক খরচ কমে আসে। যদিও বাংলাদেশে সেরকম কোন প্রচেষ্টা শুরু হয়নি।
বাংলাদেশের পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিবিসি বাংলাকে বলছেন, গত ২০/৩০ বছর ধরেই ডলারের বিকল্প মুদ্রার বিষয়ে নানা আলোচনা হয়েছে। কিন্তু তাতে এখনো কোন সফলতা আসেনি।
‘’ ইউরো ইউরোপের অনেকগুলো দেশের একক মুদ্রা হলেও এসব দেশের অর্থনীতিতে আলাদা আলাদা নীতি আছে। সব দেশের অর্থনীতিও একরকম নয়। ফলে ইউরোর পক্ষে সারা বিশ্বের একটি মুদ্রা হয়ে ওঠা অনেক চ্যালেঞ্জের। চীনের পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে, নিজেদের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তারা সেটা চায় না,’’ তিনি বলছেন।
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কের গবেষণায় দেখা গেছে, ইউরোপের দেশগুলোয় ইউরো ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হলেও অন্য অঞ্চলে এর ব্যবহার অনেক কম। ফলে সম্ভাবনা থাকলেও ডলারের বিপরীতে সেটি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি।
এক্ষেত্রে চীন একটি বিকল্প হয়ে উঠতে পারতো। কিন্তু নিজেদের অর্থনৈতিক নীতির কারণেই চীন সেটা চায় না।
আহসান এইচ মনসুর বলছেন, ‘’চীনের মুদ্রা কিন্তু এখনো পুরোপুরি বিনিময়যোগ্য মুদ্রা হিসাবে চালু হয়নি। চীন কী সেটা করবে? তারা বরং তাদের ক্যাপিটাল ধরে রাখতে চায়, নিজেদের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। এরকম চিন্তায় তাদের মুদ্রা কখনো পুরোপুরি আন্তর্জাতিক মুদ্রা হয়ে উঠতে পারবে না,‘’ বলেন মি. মনসুর।
ডলার হঠানোর চ্যালেঞ্জ
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, কোন দেশ যদি তার মুদ্রাকে ডলারের বিপরীতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে তাকে বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবের বড় ঘাটতি মেনে নিতে হবে। অর্থাৎ তার দেশে ওই মুদ্রা যতটা আসে, তার চেয়ে বেশি মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যাবে।
বর্তমানে ডলারের হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় চলতি হিসাবের ঘাটতির দেশ। অন্যদিকে চীন হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় চলতি হিসাবে সমৃদ্ধ দেশ।
অর্থনীতিবিদ ডেভিড উ বলছেন, ” চীনের মতো রপ্তানি নির্ভর দেশগুলো কখনো চাইবে না, ডলারের বিপরীতের তাদের মুদ্রার মান বেড়ে যাক। সেটা হলে তাদের রপ্তানি আয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ঠিক একই কারণে সেটা করতে চায় না জাপানের মতো দেশও।”
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ডলারের মতো করে কোন দেশ নিজেদের মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক রিজার্ভ মুদ্রা হিসাবে ব্যবহার করতে চাইলে চলতি হিসাবের বিশাল ঘাটতি তৈরি হবে।
”যুক্তরাষ্ট্র সেটা করতে রাজি আছে। কিন্তু চীন, জাপানের মতো দেশ, যাদের এখন বৈদেশিক মুদ্রার বিশাল মজুদ আছে, তারা কখনোই চাইবে না, তাদের নিজেদের মুদ্রা মান বাড়িয়ে চলতি হিসাবে বিশাল ঘাটতি তৈরি হোক, বলছেন আইএমএফের সাবেক অর্থনীতিবিদ ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের স্ট্রাটেজিস্ট ডেভিড উ।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’অনেক দেশ এখন নিজেদের মুদ্রায় লেনদেন করার চেষ্টা করছে, কিন্তু তার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসাবে বা রিজার্ভের মাধ্যম হিসাবে তারা ডলারের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারবে বলে আমি মনে করি না। কারণ এখনো ডলারকে যেভাবে বিশ্বের দেশগুলো তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাবে ব্যবহার করে, অন্য কোন মুদ্রাও সেই অবস্থায় এখনো যেতে পারেনি,‘’ বলছেন মি. উ।
ফলে আপাতত ডলারের জন্য এখনো বিশ্ববাজারে বড় কোন হুমকি দেখছেন না মি, উ।
‘’আমরা জানি ডলারের অনেক সমস্যা আছে, কিন্তু আর কোন মুদ্রা কি আছে, যেটা ডলারের চেয়ে সমস্যা কম এবং ডলারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে? এখনো তেমনটা দেখছি না।‘’