রবিবার || ২১শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ৬ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ১লা রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
আইপিএলে পাঁচ বলে পাঁচ ছয় মারা রিঙ্কু সিংয়ের উঠে আসার ‘অবিশ্বাস্য’ গল্প
প্রকাশিতঃ ১০ এপ্রিল ২০২৩, সোম, ৫:০৮ অপরাহ্ণ । পঠিত হয়েছে ৭৩ বার।
রিঙ্কু সিং এখন টুইটারে বিশ্বব্যাপী ট্রেন্ডিং, গুজরাটের নাটকীয় সন্ধ্যার পর রিঙ্কু সিংকে নিয়ে ৩ লাখেরও বেশি টুইট করা হয়েছে।
পাঁচ বলে পাঁচটি ছয় মারার পর ভারত এবং ক্রিকেট বিশ্বের তারকাদের নজর কেড়েছেন এই তরুণ।
এই তালিকায় কে নেই- রিঙ্কু সিংয়ের দল কলকাতা নাইট রাইডার্সের মালিক বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খান, ভারতের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার বিবেচিত শচীন টেন্ডুলকার, বিশ্বকাপ জয়ী অলরাউন্ডার বেন স্টোকস, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ।
শাহরুখ খান তো তার সাম্প্রতিক সিনেমা পাঠানের পোস্টারে নিজের ছবিতে ফটোশপ করে রিঙ্কু সিংয়ের মুখ বসানো ছবি শেয়ার করলেন, এতোটাই খুশি কেকেআরের এই মালিক।
কলকাতা নাইট রাইডার্সের অনেক কড়া সমর্থকও ভাবেননি কেউ ৫ বলে ২৮ রান নিয়ে ম্যাচ জিতিয়ে দিতে পারবেন।
রিঙ্কু সিং সেটা করে দেখিয়েছেন, ক্রিকেট বিশ্ব এর আগে এক বলে ছয় রান তাড়া করা দেখেছে, পাকিস্তানের জাভেদ মিয়াঁদাদ থেকে ভারতের মাহেন্দ্র সিং ধোনি এই কীর্তি গড়েছেন।
দুই বলে ১২ রান তুলে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন আইপিএলের তারকা রাহুল তেওয়াতিয়া।
কিন্তু রিঙ্কু সিং যেটা করলেন সেটা অনেকের মতেই, ‘অবিশ্বাস্য’ ও ‘অসম্ভব’।
কী হয়েছিল গুজরাটের স্টেডিয়ামে
শেষ ওভারে আইপিএলের ধারাভাষ্য কক্ষে মাইক হাতে ছিলেন সাবেক ইংলিশ ওপেনার নিক নাইট, তার কণ্ঠে প্রচন্ড ধাক্কা, অবিশ্বাস্য ও অলৌকিক কিছু দেখার আবেগ ফুটে উঠেছে তখন।
রিঙ্কু সিংকে নিয়ে ভারতের জাতীয় দলের অধিনায়ক রোহিত শর্মার টুইটে বলেছেন, “আইপিএল এমনই এক জায়গা যেখানে প্রতিভা সুযোগ পায়, অবিশ্বাস্য ইনিংস রিঙ্কু।”
ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের থেকে রিঙ্কু সিং এখন প্রশংসার বন্যায় ভাসছেন।
ভারতের উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান ডিনেশ কার্তিক টুইটারে লিখেছেন, “রিঙ্কু ইম্পসিবল সিং”।
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে গতকাল সন্ধ্যায় গুজরাটের নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামের হাজারো দর্শক এমন একটা ম্যাচ চোখে দেখেছে যেখানে আক্ষরিক অর্থে সবই ছিল।
প্রথমে ব্যাট করে স্বাগতিক দল গুজরাট টাইটান্স ২০৪ রান তুলেছিল, সেই লক্ষ্যের পথে ভালোই এগোচ্ছিল শাহরুখ খানের দল কেকেআর, কিন্তু ১৭তম ওভারে টানা তিন বলে আন্দ্রে রাসেল, সুনীল নারাইন ও শারদুল ঠাকুরকে আউট করে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়ে ম্যাচ ঘুরিয়ে দেন গুজরাটের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক রাশিদ খান।
শেষ ওভারে কলকাতার জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ২৯ রান। বল হাতে ছিল পেসার ইয়াস দয়ালের হাতে।
খুব কম দলই ৬ বলে ২৯ রান তুলতে পারে, তারওপর এটা ছিল শেষ ওভার।
সেই অসাধ্য সাধন করলেন রিঙ্কু সিং, আইপিএলের এই রঙিন মঞ্চে রিঙ্কু সিংয়ের উঠে আসার গল্পটাও এমনই, প্রায় অসাধ্য সাধন।
ভারতের সাবেক ক্রিকেটার মোহাম্মদ কাইফ একটি টুইটে লিখেছেন, “খুব সাধারণ একটা পরিবার থেকে উঠে এসেছেন রিঙ্কু সিং, আমি যেবার উত্তর প্রদেশে শেষ মৌসুম খেলি সেটা ছিল রিঙ্কু সিংয়ের শুরু।”
রিঙ্কু সিংকে সবচেয়ে পরিশ্রমী ক্রিকেটারদের একজন বলেন কাইফ।
রিঙ্কু সিংয়ের শৈশব কেটেছে অভাবে
এমন একটা ইনিংস খেলার পর রিঙ্কু সিং ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে আবেগী হয়ে পড়েন।
তিনি বলেন আমি কৃষকের পরিবার থেকে এসেছি, “অনেক কষ্ট করেছেন আমার বাবা। আমার মারা প্রতিটা ছক্কা তাদের জন্য যারা আমার ক্যারিয়ারের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন”।
আরও ছয়-সাত বছর আগে রিঙ্কুর জীবন এমন ছিল না, তখনও ক্রিকেট খেলা শুরু করেননি রিঙ্কু সিং, ভাইয়ের সাথে একটা কাজ পেয়েছিলেন।
কাজটা ছিল একটা কোচিং সেন্টারের ঝাড়ুদারের পোস্টে, কিন্তু রিঙ্কু সিং সেটা করতে চাননি।
ভাই বলতেন, ‘কেউ দেখবে না, ভোরের দিকে কাজ করে চলে আসবি’।
রিঙ্কু সিং ছিলেন অনড়।
কলকাতা নাইট রাইডার্সের অফিসিয়াল ইউটিউব পাতায় দেয়া একটা সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমার জীবনে যা পাওয়ার ছিল তা ক্রিকেটই দিতে পারতো। আমার কাছে আর কোনও অপশন ছিল না, তাই সবটুকু ক্রিকেটে ঢেলে দেয়ার চেষ্টা করেছি। ক্রিকেটার না হলে আমার জীবন হতো খুব সাধারণ।”
রিঙ্কু সিংরা পাঁচ ভাই, ছোটবেলায় আর দশটা ভারতীয় ছেলেদের মতোই টেনিস বল দিয়ে খেলতেন রিঙ্কু।
কিন্তু তার জীবনের সঙ্গী ছিল অভাব।
বিশেষত স্কুল জীবনে ক্রিকেট খেলার অনেক সুযোগ হারিয়েছেন তিনি অর্থের অভাবে, কখনো যথাযথ পোশাক কেনার পয়সা ছিল না, কখনো জুতো, কখনো বা বল।
রিঙ্কুর বাবা ছিলেন হকার।
তার পক্ষে সংসারের খরচ সামলে ওঠাই ছিল একটা কঠিন কাজ।
যেদিন বাবা রিঙ্কুকে পেটানো বন্ধ করেন
কেকেআর অফিসিয়াল ইউটিউব পাতায় রিঙ্কু সিং বলেন, বাবা ক্রিকেট পছন্দ করতেন না, কিন্তু মা অনেক সহায়তা করেছিলেন ছোটবেলায়।
“ক্রিকেট খেলার জন্য বাবা আমাদের পাঁচ ভাইকেই মারতেন, কলেজের একটা টুর্নামেন্টে সুযোগ পেয়েছিলাম কানপুরে খেলার। মা পাশের দোকান থেকে টাকা ধার করে আনেন, তখন খেলতে যাই।”
রিঙ্কু সিং বেড়ে ওঠেন ভারতের আলিগড়ে, সেখানে তিনি একটি স্কুল পর্যায়ের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের ফাইনালে তোলেন তার দলকে।
রিঙ্কু ছিলেন ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্ট, একটি মোটরসাইকেল পেয়েছিলেন তিনি পুরস্কার হিসেবে, বাবা গিয়েছিলেন সেই ফাইনাল ম্যাচ দেখতে, রিঙ্কু সিং বলেন, “সেদিনই শেষ, এরপর আর বাবা কখনো ক্রিকেট খেলার জন্য মারেননি”।
বিভিন্ন পর্যায়ের ক্রিকেট খেলে রিঙ্কু সিং সুযোগ পান উত্তর প্রদেশের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে।
দুই উইকেট ও ৮৩ রান তুলে প্রথম ম্যাচেই তিনি সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছিলেন রিঙ্কু।
ধীরে ধীরে ভারতের ক্রিকেট সংশ্লিষ্টরা রিঙ্কু সিংয়ের নাম জানতে শুরু করে
‘কখনোতো এতো টাকা একসাথে দেখিনি’
২০১৮ সালে কলকাতা নাইট রাইডার্স ৮০ লাখ রুপির বিনিময়ে রিঙ্কু সিংকে দলে নেয়।
রিঙ্কু সিং বলেন, “ওইদিনই আমাদের দরিদ্রতার অবসান ঘটে, কখনোতো এতো টাকা একসাথে দেখিনি। ঘরে আর অভাব ছিল না। জমি কিনেছি, ধার শোধ করেছি, বাড়ি তৈরি করেছি।”
রিঙ্কু কলকাতায় যাওয়ার পর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল তিনি ইংরেজিতে কথা বলতে পারতেন না, একবার আন্দ্রে রাসেলের সাথে কথা বলতে তিনি নিতিশ রানা ও শুভমন গিলকে নিয়ে যান।
কেকেআরের ভেরিফাইড ইউটিউব পাতায় রিঙ্কু বলেন, “আন্দ্রে রাসেলকে তো টেলিভিশনে দেখতাম, বড় বড় ছক্কা মারতো, ওনার সাথে কথা বলতে খুব ঝামেলা হতো। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংলিশ আমার।”
কিন্তু একটা সময় পরে রিঙ্কু তার নাচ দিয়ে রাসেলের মন জয় করে নেন।
“ড্রেসিংরুমটাই আমার ঘর, আমি সেখানে নাচি গান গাই, সবাই মজা পায়”।
রিঙ্কু আক্ষরিক অর্থেই কলকাতা নাইট রাইডার্সের প্রাণ।
কলকাতাও রিঙ্কুর প্রাণ।
তিনি বলেন, “কেকেআর আমার জীবন গড়ে দিয়েছে”।
কলকাতা নাইট রাইডার্সের সহকারী কোচ অভিষেক নায়ার রিঙ্কুকে নিয়ে বলেন, “আমরা এমন কাউকে চাচ্ছিলাম যে কি না এমন লম্বা টুর্নামেন্টে আমাদের দলের মধ্যে ইতিবাচক এনার্জি তৈরি করেন। রিঙ্কু এমনই একজন।”
মাঝে কোভিড ছিল, নানা ধরনের নিয়মের বেড়াজালে বন্দি ছিলেন ক্রিকেটাররা, এমন সময়ে কেকেআর ক্যাম্পে রিঙ্কুর মতো একজন ক্রিকেটারকে প্রয়োজন ছিল বলছে টিম ম্যানেজমেন্ট।
অভিষেক নায়ার যোগ করেন, “রিঙ্কুকে সবাই ভালোবাসে, সে কিন্তু ম্যাচের পর ম্যাচ বেঞ্চে বসে ছিল, তার মধ্যে এসব নিয়ে কোনও মাথাব্যথা ছিল না। যখনই সুযোগ পেয়েছেন কিছু করে দেখিয়েছেন।”
যেভাবে একাদশে নিয়মিত হলেন রিঙ্কু সিং
২০১৮ সাল থেকে আইপিএল খেলা রিঙ্কু গত পাঁচ বছরে মাত্র ২০ ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন।
মূলত নিজেকে মেলে ধরেছেন গত মৌসুমে।
৭ ম্যাচে ৩৪ গড় ও ১৪৮ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেছেন, রাজস্থান রয়্যালসের বিপক্ষে একটি ম্যাচ জিতিয়েছেন।
এবার তিন ম্যাচের তিনটিতেই মূল একাদশে খেলছেন এই অলরাউন্ডার।
অভিষেক নায়ার বলেন, “মাঠে ও মাঠের বাইরে দুর্দান্ত এক চরিত্র রিঙ্কু সিং”।
রিঙ্কু সিং বলেন, “আমি তো তেমন কিছু করতে পারিনি প্রথম তিন চার মৌসুম। আমার মনে হয় আমাকে সবাই ভালোবাসে, কখনো মন খারাপ করিনি এ কারণে। এটাই আমাকে শক্তি দিয়েছে।”
২০২১ সালে একটা চোট রিঙ্কু সিংয়ের পরিবারে শঙ্কা নিয়ে এসেছিল।
হাঁটুতে চোট পেয়েছিলেন তিনি, তখন পরিবারের লোকেরা বলাবলি শুরু করে দিয়েছিলেন, “চোটের কারণে রিঙ্কু যদি খেলতে না পারেন তবে তো আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবো।”
রিঙ্কু সিং বলেন, “বাড়ির সব খরচ আমিই চালাতাম তো একটা টেনশন হওয়া স্বাভাবিক। বাবা দুইদিন খাবার খাননি ইনজুরির কথা শুনে। আমি তাদের বললাম, ‘ক্রিকেটে এসব হতে থাকে।’”।
রিঙ্কু সিংয়ের সেই চোট সারতে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল, সাত-আট মাস মাঠের বাইরে ছিলেন।
কেকেআরের প্রধান চিকিৎসক কমলেশ জেইন বলেন, “রিঙ্কু সিং মানসিকভাবে খুব শক্তিশালী ছিলেন।”
এরপর রিঙ্কু সিং ফিরে আসেন, ২০২১ সালে না খেলতে পারলেও ২০২২ সালের জন্য তাকে আবারও দলে নেয় কলকাতা নাইট রাইডার্স এবং তখন নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দেন।
রিঙ্কু সিং যেবার প্রথম ম্যাচসেরার পুরস্কার পান, আলিগড়ের বাসায় প্রচুর সাংবাদিকরা জড়ো হয়েছিলেন, বাবা-মা রিঙ্কুকে ফোন দিয়ে বলেন, ‘কী বলবো বুঝতে পারছি না’।
রিঙ্কু বলেন, “অভ্যাস করে ফেলো, এখন এগুলো সহ্য করতেই হবে”।
রিঙ্কু সিং এখনও বিশ্বাস করতে পারেন না তার এই যাত্রা, ‘মাঝেমধ্যেই মনে হয় এটা অলৌকিক কিছু’।