শনিবার || ২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ৭ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৩রা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
আসামের করিমগঞ্জ নাম বদলে শ্রীভূমি, রবীন্দ্রনাথের আদৌ কোনও যোগ আছে?
প্রকাশিতঃ ২০ নভেম্বর ২০২৪, বুধ, ১১:১৭ অপরাহ্ণ । পঠিত হয়েছে ১২ বার।
ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ লাগোয়া করিমগঞ্জ জেলাটির নাম বদল করে শ্রীভূমি রাখা হবে।
মঙ্গলবার আসামের রাজধানী দিসপুরে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা নামবদলের এই ঘোষণা করেছেন।
তারপরেই করিমগঞ্জ জেলায় বিজেপি ও সেটির সহযোগী সংগঠনগুলির কর্মী সমর্থকদের উল্লাস শুরু হয়ে যায়। দলীয় দফতরে তারা বাজিও ফাটান।
তবে জেলার অন্য বাসিন্দারা হঠাৎ নাম বদলের সিদ্ধান্তে কিছুটা ক্ষুব্ধ। ঘটনাচক্রে বাংলাদেশের জকিগঞ্জ লাগোয়া ওই জেলাটির প্রায় ৫৫ শতাংশ মুসলমান।
সেখানকার বিদ্বজ্জনেরা বলছেন করিমগঞ্জ একটি ঐতিহাসিক নাম। নাম বদল করার কোনও জোরালো গণ-দাবি যেমন ওঠে নি কখনই। তবে হিন্দুত্ববাদী নানা সংগঠন বিভিন্ন সময়ে করিমগঞ্জ নাম বদল করে ‘শ্রীভূমি’ রাখার দাবি তুলেছিল।
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সহ বিজেপির নেতারা বলছেন শ্রীভূমি নামটি আসলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া।
ইতিহাসবিদরা জানাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি ১০ লাইনের নামহীন কবিতা লিখেছিলেন, যেখানে সুন্দরী শ্রীভূমির উল্লেখ আছে। কিন্তু সেটা তিনি লেখেন ১৯৪৭-পূর্ব অবিভক্ত সুরমা ভ্যালি ডিভিশনের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে। বাংলা থেকে দূরে ‘নির্বাসিত’ হয়ে আছে শ্রীভূমি – এটাই লিখেছিলেন তিনি।
তাই শ্রীভূমি নাম কখনই করিমগঞ্জ জেলাকে বর্ণনা করতে লেখেন নি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এমনটাই মত একাধিক ইতিহাসবিদের।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অরিজিত আদিত্য বলছেন ইসলামি নাম বদল করে দেওয়ার যে প্রথা বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে চলছে, করিমগঞ্জের নাম বদলও সেই একই ধারার অনুসরণ।
করিমগঞ্জের নাম বদল প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা যে কবিতাটির কথা তোলা হচ্ছে, সেটি দশ লাইনের একটি নামহীন কবিতা।
তিনি লিখেছিলেন : মমতাবিহীন কালস্রোতে/ বাঙলার রাষ্ট্রসীমা হোতে/ নির্বাসিতা তুমি / সুন্দরী শ্রীভূমি।“
“এই কবিতাটির একটা প্রেক্ষাপট আছে,” বলছিলেন শিলচরের আসাম ইউনিভার্সিটির প্রথম ও প্রাক্তন উপাচার্য, ইতিহাসবিদ জয়ন্ত ভূষণ ভট্টাচার্য।
তার কথায়, “১৯১৯ সালে সিলেট বা শ্রীহট্ট যাওয়ার পথে রবীন্দ্রনাথ একবারই করিমগঞ্জে এসেছিলেন। তখন সেটা ছিল সুরমা ভ্যালি ডিভিশন। ট্রেনে আসার পথে সুরমা ভ্যালির সৌন্দর্য দেখে এবং মূল বাংলা থেকে ‘নির্বাসিত’, অর্থাৎ বাংলা থেকে সিলেট এবং কাছাড়কে বার করে নিয়ে আসামের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার ‘কষ্ট’ দেখেই রবীন্দ্রনাথ ওই পঙক্তিটি লেখেন। করিমগঞ্জ স্টেশনে তিনি কিছুক্ষণ ছিলেন ঠিকই, তবে সেখানে বসেও কবিতাটি তিনি লেখেন নি।
“তাই করিমগঞ্জ জেলাকে রবীন্দ্রনাথ শ্রীভূমি হিসাবে বর্ণনা করেছেন বা তার স্বপ্ন ছিল শ্রীভূমি নামটি, এই আখ্যানের কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই,” বলছিলেন অধ্যাপক জয়ন্ত ভূষণ ভট্টাচার্য।
করিমগঞ্জের ইতিহাস গবেষক বিবেকানন্দ মহন্ত বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলং থেকে গুয়াহাটি হয়ে ট্রেনে বদরপুর হয়ে করিমগঞ্জ আসেন ১৯১৯ সালের চৌঠা নভেম্বর। সেই ট্রেনটির নাম ছিল সুরমা মেইল। কবিগুরুকে স্টেশনেই সম্বর্ধনা দেওয়া হয় স্থানীয় মানুষের উদ্যোগে। যে ট্রেন মাত্র তিন মিনিট থামার কথা, তা সেদিন থেমেছিল প্রায় ২৫ মিনিট।
“এখান থেকে ট্রেনটি পৌঁছয় কুলাগুরা জংশন স্টেশনে। এখন সেটি বাংলাদেশে। ওই স্টেশন থেকে তখন সবেমাত্র সিলেট শহরে যাওয়ার একটি রেললাইন বসেছে। রাত্রে ওই লাইনে ট্রেন চলত না। তাই রবীন্দ্রনাথ ট্রেনেই রাত কাটান এবং পরের দিন সকাল সাড়ে নয়টা নাগাদ সিলেট শহরে পৌঁছন। বাংলাদেশের কুলাগুরা জংশনে রবীন্দ্রনাথে আগমনকে স্মরণ করে একটি বিরাট হোর্ডিং আমি দেখে এসেছি,” বলছিলেন মি. মহন্ত।
করিমগঞ্জে একবারই মাত্র গেলেও ওই জেলা এবং কাছাড়, সিলেট অঞ্চল থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনে অনেক ছাত্র এবং অধ্যাপকই গিয়েছিলেন।
তার সেই ১৯১৯ সালের সিলেট যাত্রায় যেসব ভাষণ দিয়েছিলেন, তা শুনতে হাজির ছিলেন সেই সময়ে স্কুল ছাত্র, পরবর্তীকালে বিশিষ্ট সাহিত্যকার সৈয়দ মুজতবা আলিও, বলছিলেন ইতিহাস গবেষক বিবেকানন্দ মহন্ত।
করিমগঞ্জ জেলা হিসাবে স্বীকৃতি পায় ১৯৮৩ সালে। তার আগে এটি মহকুমা শহর ছিল। দেশভাগের আগে অবশ্য সিলেটের অধীন একটি থানা অঞ্চল ছিল করিমগঞ্জ।
“আনুষ্ঠানিকভাবে করিমগঞ্জ মহকুমা হয় ১৮৮৪ সালে। এই অঞ্চলে একজন মিরাসদার বা ছোট জমিদার ছিলেন মুহম্মদ করিম চৌধুরী নামে। তার নাম থেকেই এলাকার নাম করিমগঞ্জ হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে সিলেট বা শ্রীহট্টের একটি থানা ছিল এই করিমগঞ্জ,”বলছিলেন বিবেকানন্দ মহন্ত।
তার কথায়, “আনুষ্ঠানিকভাবে করিমগঞ্জ থানার নাম এর কয়েক বছর আগে, ১৮৭৪ সালে এসেছিল। ব্রিটিশ সরকার বাংলা প্রদেশ থেকে সিলেট আর অন্য প্রান্তে কোচবিহার থেকে গোয়ালপাড়াকে সরিয়ে এনে আসাম প্রদেশের সঙ্গে জুড়ে দেয়। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন যখন হয়, সেই ১৯০৫ সালে, তখন দাবি উঠেছিল যে সিলেটকে বাংলার সঙ্গে আবারও যুক্ত করে দেওয়ার। বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব রোধ হয়ে গেলেও সিলেট কিন্তু আসামেই থেকে গেল।।
সিরিল র্যাডক্লিফের নির্ধারিত ‘র্যাডক্লিফ লাইন’এর একদিকে পড়ে সিলেট, অন্যদিকে চলে যায় করিমগঞ্জছবির উৎস,Getty Images
ছবির ক্যাপশান,সিরিল র্যাডক্লিফের নির্ধারিত ‘র্যাডক্লিফ লাইন’এর একদিকে পড়ে সিলেট, অন্যদিকে চলে যায় করিমগঞ্জ
৪৭-এর সিলেট গণভোট
ভারতের স্বাধীনতার আগে সিলেট পাকিস্তানে যাবে না কি ভারতে, তা নির্ধারণ করতে গণভোট নেওয়া হয়েছিল।
সেই ভোটে আসামের কংগ্রেস নেতারা মুসলমান প্রধান সিলেটকে নিজেদের রাজ্যে নিতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না বলেই ইতিহাসবিদরা মনে করেন।
অন্যদিকে মুসলিম লীগ সিলেটকে পাকিস্তানে নিয়ে যেতে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত সিলেটের অধিকাংশ মানুষ পাকিস্তানের পক্ষেই ভোট দেন। তবে র্যাডক্লিফ লাইন সিলেটের একটা অংশকে আলাদা করে দেয় – ভারতের দিকে আসে সিলেটের করিমগঞ্জ অংশটি।
ইতিহাস গবেষক বিবেকানন্দ মহন্ত বলছেন, “সিলেটে সেই সময়ে ছয়টি থানা ছিল। এর মধ্যে সাড়ে তিনটে থানা পাকিস্তানে আর আড়াইটে থানা ভারতের দিকে আসে। ওই আড়াইটে থানা এলাকা নিয়েই এখনকার করিমগঞ্জ জেলা।”
বিজেপি শাসিত আসাম সরকারের এই নাম বদলের সিদ্ধান্তে বারবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রসঙ্গ তুলে আনছেন দলটির নেতা কর্মীরা।
ভারতের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ রাজ্যসভায় বিজেপির সংসদ সদস্য ও করিমগঞ্জের মানুষ মিশন রঞ্জন দাস বলছিলেন, “বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আরএসএসের মতো নানা সংগঠন দীর্ঘদিন ধরেই দাবি তুলছিল যে করিমগঞ্জ জেলার নাম বদল করা হোক। রবীন্দ্রনাথ যে নামে বর্ণনা করেছেন, সেই শ্রীভূমি রাখার দাবিও বারেবারে উঠেছে। আমাদের দলের এটা তৃতীয় সরকার চলছে আসামে, তবুও এত দেরি হল সেই দাবি আদায়ে। তবে করিমগঞ্জের মানুষ অত্যন্ত খুশি এই সিদ্ধান্তে।“
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও শিলচর ভিত্তিক দৈনিক বার্তালিপির সম্পাদক অরিজিত আদিত্য অবশ্য বলছিলেন যে করিমগঞ্জের মানুষের পক্ষ থেকে কখনই জেলার নাম বদল করার জোড়ালো দাবি ওঠে নি।
তার কথায়, “এটা কখনই ওই জেলার মানুষের গণদাবি ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের করিমগঞ্জ আগমনের শতবর্ষ উপলক্ষে ২০১৯ সালে সেখানে একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেখানে হোজাইয়ের প্রাক্তন বিজেপি বিধায়ক শিলাদিত্য দেব করিমগঞ্জ নাম বদলিয়ে শ্রীভূমি রাখার প্রস্তাব তুলেছিলেন।
“এখন রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নাম বলে চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু আসলে এটা বিজেপির একটা ধর্মীয় মেরুকরণের প্রচেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়। ঠিক যেভাবে উত্তরপ্রদেশ সহ নানা বিজেপি শাসিত রাজ্যে ইসলামি শহর বা এলাকার নাম বদলানো হয়েছে, এখানেও সেভাবেই করিমগঞ্জ নাম বদলানো হল,” বলছিলেন অরিজিত আদিত্য।
তিনি আরও বলছিলেন, “করিমগঞ্জের নাম বদল করা হল, অথচ শিলচর স্টেশনটির নাম যে দীর্ঘদিন ধরে বদল করে ভাষা শহীদ স্টেশন হিসাবে ঘোষণা করার দাবি উঠে আসছে। বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলনে ১৯৬১ সালের ১৯শে মে যে ১১ জন শহীদ হয়েছিলেন, তাদের স্মরণে স্টেশনের নামকরণ যথার্থই একটা গণ-দাবি। কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন পাওয়া গেলেও আসাম সরকার নানা অজুহাতে বিষয়টিকে আটকে রেখেছে।“
তবে বিজেপির সংসদ সদস্য মিশন রঞ্জন দাস মনে করেন না যে করিমগঞ্জ নাম বদলের সঙ্গে কোনও রাজনীতি আছে।
তার কথায়, “অন্য প্রদেশে সেখানকার বিজেপি সরকার কী করেছে, তা নিয়ে আমার মন্তব্য করা উচিত নয়। অন্যান্য রাজ্যে নাম বদলের যেসব উদাহরণ আপনি দিচ্ছেন, সেভাবে কোনও নাম বদল করে নি আসামের বিজেপি সরকার। করিমগঞ্জের নাম বদলটাই প্রথম উদাহরণ।“
অধ্যাপক জয়ন্ত ভূষণ ভট্টাচার্য বলছিলেন, “পুরো বরাক-সুরমা ভ্যালির বাসিন্দারাই গর্ব করে নিজেদের ‘শ্রীভূমি’র সন্তান বলে থাকেন। আমাদের জন্মভূমির এই অঞ্চলকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে নামে বর্ণনা করে গেছেন, তা নিয়ে আমাদের যথেষ্ট গর্ব আছে।
“কিন্তু এখন শুধুমাত্র করিমগঞ্জকে ‘শ্রীভূমি’ বলে নাম দিয়ে দেওয়ার ফলে বরাক-সুরমা ভ্যালি সহ বৃহৎ সিলেটের মূল বাসিন্দাদের কাছ থেকে ওই নামটি ব্যবহার করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হল। একটা মাত্র জেলায় রবীন্দ্রনাথের দেওয়া এই নামটা আটকিয়ে দেওয়া হল। এটাই আমাদের কষ্টের জায়গা,” বলছিলেন অধ্যাপক ভট্টাচার্য।—বিবিসি