শনিবার || ২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ৭ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৩রা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন নেপালিরা: বিবিসি নেপালির তদন্তে যা জানা যাচ্ছে
প্রকাশিতঃ ২৯ জুন ২০২৩, বৃহঃ, ১১:৫৩ অপরাহ্ণ । পঠিত হয়েছে ১৭৯ বার।
রামেশ (ছদ্মনাম) উন্নত জীবনের আশায় স্টুডেন্ট ভিসায় নেপাল থেকে রাশিয়ায় এসেছিলেন। নেপালে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থাকা এই তরুণ কোনোভাবে চেয়েছিলেন এ থেকে মুক্তি পেতে।
পড়াশোনা শেষে হয় তিনি নেপালে ফিরে গিয়ে সাধারণ কোন চাকরি করতেন অথবা রাশিয়ায় ভালো কোন চাকরি খুঁজতেন। কিন্তু এসব এতো সোজা ছিল না।
নেপাল সরকারের এক সমীক্ষা অনুসারে, ২০১৭-১৮ সালে দেশটিতে বেকারত্বের হার ছিল ১১.৪ শতাংশ।
এর আগে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে বলেছে যে, নেপালের বেশিরভাগ চাকরি অসংগঠিত খাত সংশ্লিষ্ট। যেখানে যথেষ্ট বেতন মিলে না।
রামেশ বিবিসি নেপালিকে অনলাইনে এক আলাপচারিতায় জানান, “আমার মতো রাশিয়ায় আসা অন্য ছাত্ররা একই দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তারা ভালো কোন চাকরি পাচ্ছে না।”
রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে টিকটক ভিডিও
রামেশ এবং তার মতো নেপালের আরও অনেকে যখন এমন এক সংশয়ের সাথে লড়াই করেছিল তখন রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ শুরু করে। ইউক্রেনের ওই যুদ্ধে রুশ সেনাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
যুদ্ধের শুরু দিকে হাজার হাজার রুশ সৈন্য মারা যান। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং তার সাংসদরা রুশ আইনে কিছু পরিবর্তন আনেন। যেন সেনাবাহিনীতে বিদেশিদের যোগদান সহজ ও আকর্ষণীয় হয়।
মস্কো তার সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য এক প্রকার লাল গালিচা বিছিয়ে বিদেশিদের স্বাগত জানিয়েছে।
যেখানে মোটা অংকের বেতন থেকে শুরু করে রাশিয়ার নাগরিক হওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করাসহ নানা সুবিধা দেয়া হয়।
রামেশ বলেছেন যে, তিনি রুশ সেনাবাহিনীতে যোগদানের লাভজনক প্রস্তাব গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি জানিয়েছেন যে, তিনি লিখিত পরীক্ষা এবং মেডিকেল পরীক্ষার পরে রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে নির্বাচিত হন।
তিনি বলেছেন যে, তিনি এই প্রক্রিয়ায় এক লাখ নেপালি রুপি ব্যয় করেছেন, তবে তিনি কাকে এই অর্থ প্রদান করেছেন তা প্রকাশ করেননি।
“[নথিভুক্তির] আবেদন ও যোগদানের কাজটি আস্থার ভিত্তিতে করা হয়,” তিনি বলেন।
রামেশ তার টিকটক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তার সেনাবাহিনীতে যোগদানের খবর ছড়িয়ে দেন। সেখানে রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার নানা উপায়ের কথা তুলে ধরা হয়।
তার অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা বিভিন্ন ভিডিওতে তিনি বলেছেন যে এই সিদ্ধান্ত নেয়া তার জন্য কতোটা কঠিন ছিল।
“একজন সৈনিকের কাজ হল ‘হয় করো না হলে মরো’। আপনি যদি এমনটা করতে চান তবেই যোগ দিন।” একটি ভিডিওতে তিনি এমন একটি বার্তা লিখেছেন।
“তথ্যমূলক” শিরোনামে অন্য একটি ভিডিওতে তিনি বলেছেন: “এখানে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আপনি যা আশা করবেন তেমনটা হবে না। আমি মনে করি এটা জীবনের কঠিন দিক। কারণ এই দেশটি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লড়াই করছে।”
রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগদানের ‘কাউন্সেলিং সার্ভিস’
বিবিসি শেষবার যখন রামেশের সাথে যোগাযোগ করে, তখন তিনি বলেছিলেন যে তার কাছে খুব কম সময় আছে কারণ তাকে প্রশিক্ষণের জন্য বেলারুশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরপর থেকে বিবিসি তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি।
এক সপ্তাহের দীর্ঘ তদন্তে, বিবিসি নেপালি দেখতে পেয়েছে যে রামেশই একমাত্র নেপালি নন যিনি রাশিয়ান বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন।
রাজও একজন শিক্ষার্থী হিসেবে উচ্চ শিক্ষার জন্য রাশিয়ায় গিয়েছিলেন। মস্কো যখন ২০২২ সালের এপ্রিলে তাদের সেনাবাহিনীতে বিদেশিদের নিয়োগ প্রক্রিয়া ঘোষণা করে, তখন তিনি নেপালিদের কাছ থেকে সাহায্যের জন্য কল পেতে শুরু করেন।
তারা মূলত চাইছিলেন যেন রাজ তাদের রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য রুশ ভাষায় ফর্ম পূরণ করতে সহায়তা করে। কারণ তাদের রুশ ভাষা সম্পর্কে কম জ্ঞান ছিল।
তিনি বিবিসিকে বলেন, “আমি কিছু নেপালিদের রুশ সেনাবাহিনীতে নাম লেখাতে আবেদনপত্র পূরণের জন্য সাহায্য করেছিলাম, যাদের সাথে আমার পরিচয় ছিল। বর্তমানে, তারাই রুশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে ইচ্ছুকদের আমার ফোন নম্বর দিচ্ছেন,” তিনি বিবিসিকে বলেন।
রাজ মূলত রাশিয়ায় পড়াশোনার উদ্দেশ্যে আসতে ইচ্ছুক নেপালি শিক্ষার্থীদের পরামর্শদাতা বা কাউন্সেলর হিসেবে কাজ করতেন।
এখন রাশিয়ান সেনা পদে যোগদানের জন্য প্রাক্তন নেপালি সৈন্য এবং ছাত্ররা তার কাছে সাহায্য চাইতে আসেন।
তিনি এক সময়ে ৪০-৫০টি ফোন কল পান এবং তাদের বেশিরভাগই জানতে চাইতো যে তারা কীভাবে রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারে।
কিছু নেপালি যুবক যারা তাদের রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগদানের ভিডিও পোস্ট করেছিল তারা বিবিসিকে রাজের পরিচয় দেয়।
রাজ বলেছেন যে নেপালিদের রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া অবৈধ কিনা তা তিনি জানেন না। তিনি বলেছেন যে তিনি তার সেবার জন্য কোনও অর্থ গ্রহণ করেন না – তবে কিছু নেপালি যারা তার সাহায্য নিয়েছিলেন তারা দাবি করেছেন যে তারা প্রত্যেকে তাকে এক লাখ করে নেপালি রুপি দিয়েছে৷
নেপাল সরকারের নিয়ম কানুন কি বলে?
ইউক্রেনে রুশ হামলার নিন্দা জানিয়েছে নেপালি সরকার এবং তারা পশ্চিমা দেশগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছে।
নেপাল বলেছে যে, তাদের নাগরিকদের রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার বিষয়ে কোনও তথ্য তাদের কাছে নেই।
নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেওয়া লামসাল বিবিসি নেপালিকে বলেছেন, “এটি আমাদের নীতির সাথে যায় না।”
১৯৪৭ সালে নেপালি নাগরিকদের বিদেশি সেনাবাহিনীতে নিয়োগের বিষয়ে ব্রিটেন, নেপাল এবং ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
চুক্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে নেপালি নাগরিকদের ভারতীয় ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হবে।
একইসাথে, এটিও উল্লেখ করা হয়েছে যে নেপালিদের যারা তাদের সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দেবে সেখানে তাদেরকে “ভাড়াটে হিসেবে গণ্য করা হবে না”।
এর বাইরে অন্য কোনও দেশের সেনাবাহিনীতে যোগদানের ক্ষেত্রে নিজ দেশের নাগরিকদের সমর্থন করার কোনও নীতি সরকারের নেই।
বিবিসি নেপালি এই বিষয়ে জানতে মস্কোতে কাঠমান্ডুর রাষ্ট্রদূত মিলনরাজ তুলাধারের সাথে যোগাযোগ করেছে।
“যারা রাশিয়ায় বেড়াতে বা পড়াশুনার উদ্দেশ্যে আসে তারা অন্য নানা কাজে নিয়োজিত হতে পারে না। নেপালের শুধুমাত্র ভারত এবং ব্রিটেনের সাথে সেনা নিয়োগের বিষয়ে একটি চুক্তি রয়েছে; রাশিয়ার সাথে এ বিষয়ক কোন চুক্তি নেই,” তুলাধার বলেন।
তিনি আরও বলেন যে, টিকটকে পোস্ট করা ভিডিওগুলি যাচাই করা যায়নি।
বিবিসির তদন্তে যা পাওয়া গেছে
বিবিসি এরকম কিছু টিকটক ভিডিও তদন্ত করে দেখেছে যে সেগুলি রাশিয়ার ভেতরে যেখানে সামরিক ক্যাম্প রয়েছে এমন এলাকা থেকে পোস্ট করা হয়েছে।
কিছু অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা নথিগুলো বিবিসি রাশিয়ান সার্ভিসের মাধ্যমে যাচাই করা হয়েছে। বিবিসি রাশিয়ান সার্ভিসের সাংবাদিক আন্দ্রে কোজেনকো অন্তত দুটি অ্যাকাউন্ট চেক করেছেন যেখানে রাশিয়ার সামরিক নথির ছবি পোস্ট করা হয়েছে।
“আমাদের হাতে আসা দুটি নথি থেকে জানা যায় ওই দুই যুবক রাশিয়ান সামরিক বাহিনীতে রয়েছে,” কোজেনকো বলেছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সামরিক পদমর্যাদা, পুরো নাম ও অভিভাবকের নাম ওই নথিতে প্রকাশ করা হয়। নথিতে তারা যে সামরিক ইউনিটগুলোর জন্য কাজ করে সে সম্পর্কেও তথ্য রয়েছে।
বিবিসি রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে জানতে কাঠমান্ডুতে রাশিয়ান দূতাবাসের সাথে ইমেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছে। তবে এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় পর্যন্ত তাদের কোনও প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।
কেন রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে নেপালি যুবকরা?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেপালে ভালো সুযোগের অভাব রয়েছে যার কারণে দেশটির তরুণরা বিদেশি সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছে।
ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী টিকারাম গৌতম বলেন, “নেপালিরা পড়াশোনা বা বেড়াতে যাওয়ার অজুহাতে বিদেশে গেলেও, তাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে সেখানে গিয়ে কাজ করা এবং উপার্জন করা।”
এই তরুণদের রাশিয়ান সেনাবাহিনীর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার সম্ভাব্য কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “সেনাবাহিনীতে তারা কয়েক মাসে যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছে তার সমপরিমাণ আয় কোন খাত থেকে করতে গেলে অন্তত কয়েক বছর সময় লাগতো।”
নেপাল সরকারের পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৭২৯ নেপালি বিভিন্ন উদ্দেশ্যে রাশিয়ায় গিয়েছে।
নেপালের অভিবাসন বিভাগের তথ্য মতে, তাদের মধ্যে ৭৪৯ নেপালি শিক্ষার্থী হিসেবে রাশিয়ায় গিয়েছে এবং বাকি ৩৫৬ জন নেপালি গিয়েছে চাকরির উদ্দেশ্যে।
রাশিয়ায় অবস্থানরত যে নেপালিদের সাথে আমরা কথা বলেছিলাম, রাজসহ যারা তাদের রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে সাহায্য করেছিল, তাদের বক্তব্যেও ঘুরে ফিরে মি. গৌতমের যুক্তি উঠে আসছে।
“আমরা এখানে টাকার জন্য এসেছি,” এমনটাই বলেছেন রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া এক ব্যক্তি। এবং এ নিয়ে তিনি টিকটকে একটি ভিডিও করেছেন।
“আমাদের এখানে যা অফার করা হয় আমরা সেটা নেপালে উপার্জন করতে পারি না। আপনি অন্য দেশেও এত পরিমাণ উপার্জন করতে পারবেন না। আপনাদের যাদের হৃদরোগের সমস্যা নেই তারা এখানে আসতে পারেন,” তিনি বলেন।
আরেকজন যুবক যার সাথে বিবিসির কথা হয়েছিল তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, “আমরা যদি আমাদের জীবনের মায়ায় নেপালে ফিরে আসি, সেখানে কী আমরা চাকরি পাব?”
রাশিয়ায় নেপালিরা কত বেতন পাচ্ছে?
যারা ইউক্রেনে রাশিয়ার পক্ষে লড়াই করবে তাদেরকে আরও বেশি বেতন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রাশিয়ার সরকার।
রাজ বলেন, প্রশিক্ষণের সময় নেপালিদের ৬০ হাজার নেপালি রুপির সমান বেতন দেওয়া হয়।
আরেকজন যিনি রাশিয়ান সামরিক প্রশিক্ষণে আছেন বলে দাবি করেছেন, তার চুক্তিতে বলা হয়েছে যে “প্রশিক্ষণের সময়কাল পার হওয়ার পরে তাকে প্রতি মাসে এক লাখ ৯৫ হাজার রুবল বেতন দেওয়া হবে।”
“এই বেতনের মূল্য তিন লাখ নেপালি রুপির বেশি। এক বছরের চুক্তি শেষ হওয়ার পরে, সৈন্যরা রাশিয়ান পাসপোর্ট পাবেন এবং তারা তাদের পরিবারের সদস্যদেরও রাশিয়ায় আনতে পারবেন,” রাজ বলেন।