শনিবার || ২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ || ৭ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ৩রা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
কবরের উপর নৃত্য: ৩২ বছর আগে যে হত্যাকাণ্ড ভারতকে নাড়া দিয়েছিল
প্রকাশিতঃ ৪ মে ২০২৩, বৃহঃ, ১০:৫৭ অপরাহ্ণ । পঠিত হয়েছে ৮৮ বার।
শাকেরেহ খালিলি ছিলেন “ধনী এবং সুন্দরী”। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের অন্যতম অভিজাত পরিবারের সদস্য ছিলেন এই নারী।
কিন্তু ১৯৯১ সালে এই ধনাঢ্য উত্তরাধিকারী হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান। যেন তিনি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন।
তিন বছর ধরে, তার দ্বিতীয় স্বামী – মুরলী মনোহর মিশ্র, যিনি স্বামী শ্রদ্ধানন্দ নামে বেশি পরিচিত – তিনি শাকেরেহ’র হদিস সম্পর্কে চমৎকার সব গল্প বানিয়েছিলেন।
১৯৯৪ সালে, শাকেরেহ’র দেহাবশেষ ব্যাঙ্গালুরু (তৎকালীন ব্যাঙ্গালোর) শহরে তাদের বিলাসবহুল বাড়ির আঙিনা খুড়ে বের করে আনা হয়।
শাকেরেহকে নেশাগ্রস্ত করে একটি কাঠের বাক্সে ভরা হয় – পরে জানা যায় – তাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল।
২০০৩ সালে, বিচারিক আদালত শ্রদ্ধানন্দকে হত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত করে এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, এই রায় পরে উচ্চ আদালতেও বহাল থাকে।
আদালত জানায় যে শ্রদ্ধানন্দ শাকেরেহ’র কোটি কোটি রুপির সম্পত্তির জন্য তার পিছু নিয়েছিলেন এবং বিয়ে করেছিলেন।
তিনি আপিল আবেদন করলে সুপ্রিম কোর্ট একে “একজন মানুষের ঘৃণ্য লোভের সাথে শয়তানের ধূর্ততার ঘটনা” হিসেবে অভিহিত করে।
তবে তার শাস্তি কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। গত সপ্তাহে সর্বোচ্চ আদালত তার প্যারোলে মুক্তির আবেদনও খারিজ করে দেয়।
পুরো ভারতকে নাড়া দেয়া প্রায় ৩০ বছর আগের এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে ঘিরে নতুন ওয়েব শো স্ট্রিম করছে-অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও। যার শিরোনাম করা হয়েছে ‘ড্যান্সিং অন দ্য গ্রেভ’- অর্থাৎ কবরের ওপর নৃত্য।
এই নামকরণের কারণ হল শ্রদ্ধানন্দ যেখানে বিভিন্ন নাচের পার্টির আয়োজন করতেন সেই আঙিনার নীচেই তার স্ত্রীকে কবর দেয়া হয়েছিল।
ইন্ডিয়া টুডে অরিজিনাল প্রোডাকশনের প্রযোজক চাঁদনি আহলাওয়াত দাবাস বলেছেন যে, এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে ঘিরে “কী, কেন, কীভাবে” এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল যা এখনও অবিশ্বাস্য মনে হয়।
“৩০ বছর আগের ঘটনা হওয়া সত্ত্বেও, আমাদের মনে হয়েছে যে এটি এমন এক অপরাধ যা সবার সামনে আসা দরকার কারণ এটি আজও রহস্য হয়ে আছে,” তিনি যোগ করেন।
খুন এবং খুনিকে নিয়ে এই সিরিজটি হয়তো সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি, কিন্তু এটি টানটান উত্তেজনাপূর্ণ এবং ভারতে অনেকের মনোযোগ কেড়েছে।
চার পর্বের সিরিজের প্রথম দুই পর্বে শাকেরেহ’র জীবন নিয়ে আলোচনা করা হয়।
তিনি ছিলেন স্যার মির্জা ইসমাইলের নাতনি। মির্জা ইসমাইল মহীশুর, ব্যাঙ্গালুরু, জয়পুর এবং হায়দ্রাবাদের রাজকীয় রাজ্যগুলোর দেওয়ান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
বেশ কয়েকটি ল্যান্ডমার্ক ভবন এবং স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য তাকে কৃতিত্ব দেয়া হয় – শাকেরেহ তেজী কূটনীতিক আকবর খালিলিকে বিয়ে করেন এবং চার মেয়ের মা হন।
পরিবারের সদস্যরা শাকেরেহকে “মুগ্ধতা ছড়ানো, জীবনের চেয়ে বড় চরিত্র” হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন যার ছিল “পুরনো গাড়ি রাখার সখ, তিনি ছিলেন খুব সামাজিক, খুবই ভালোবাসা দেয়া-নেয়ার মতো মানুষ”।
কিন্তু ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি, তিনি শ্রদ্ধানন্দের সাথে দেখা করেন এবং তার জীবনে বড় ধরণের মোড় ঘুরে যায়।
বিবিসি হিন্দির ইমরান কুরেশি সেই সময়ে ব্যাঙ্গালুরুতে টাইমস অফ ইন্ডিয়া পত্রিকায় কাজ করতেন।
তিনি ডকুসিরিজটির কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে বলেন “হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি মানুষকে হতবাক করেছিল বিশেষ করে তাকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল – সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল তাকে জীবন্ত কবর দেওয়ার বিষয়টি”।
ঘটনাটি “টক অফ দ্য টাউন বা মুখ্য আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয় কারণ শাকেরেহ তার প্রথম স্বামীকে তালাক দেওয়ার পরে শ্রদ্ধানন্দের মতো একজনকে বিয়ে করেছিলেন”, তিনি যোগ করেছেন।
সেই সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন খবর থেকে জানা যায়, শ্রদ্ধানন্দ ছিলেন দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা যিনি স্কুলের গণ্ডিও পেরোতে পারেননি, ছিলেন একজন ভণ্ড সাধু এবং আপাতদৃষ্টিতে একজন কাজের লোক।
যিনি শাকেরেহ’র “কিছু সম্পত্তির সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে” এবং ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতার মাধ্যমে শাকেরেহর ছেলে সন্তান লাভের ইচ্ছা পূরণের কথা বলে তার প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ১৯৮৬ সালে তাদের বিয়ের পরপরই তাদের সম্পর্ক ঘোলাটে হতে শুরু করে এবং দুজনের মধ্যে প্রায়শই ঝগড়া বেধে যেতো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আর্থিক বিষয় নিয়ে। তারই ধারাবাহিকতায় শ্রদ্ধানন্দ তার স্ত্রীকে এতোটা জঘন্যভাবে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন বলে মনে করা হয়।
কিন্তু ভারতের বিচারিক আদালত, হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টের মোট আটজন বিচারক তাকে দোষী সাব্যস্ত করা সত্ত্বেও, শ্রদ্ধানন্দের আইনজীবী জোর দিয়ে বলেছেন যে তার মক্কেলের বিরুদ্ধে আসা প্রমাণগুলো সবাই পরোক্ষ বা পরিস্থিতিগত –(অর্থাৎ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত প্রমাণ নয়) এবং ওয়েব সিরিজে, আমরা শুনেছি শ্রদ্ধানন্দ নিজেকে এখনও নিরপরাধ দাবি করেন।
কেউ কেউ দোষী সাব্যস্ত হওয়া খুনিকে কথা বলার এমন সুযোগ দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কিন্তু মুম্বাই-ভিত্তিক ব্রিটিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা প্যাট্রিক গ্রাহাম, যিনি ড্যান্সিং অন দ্য গ্রেভের পরিচালক এবং সহ-রচয়িতা তিনি এর জবাবে বলেন,তার গল্পে শ্রদ্ধানন্দের অনেক কথা উঠে আসায় তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তিনি বিবিসিকে বলেন, “আমি মনে করি এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা তার দিকের গল্পটাও যেন শুনি, কারণ আমরা গত ৩০ বছরে তার কোন বক্তব্য শুনিনি। তাছাড়া, তিনি আমাদের শাকেরেহর চরিত্র নিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দিয়েছেন,” তিনি বিবিসিকে বলেছেন।
গ্রাহাম বলেছেন যে, তাদের দলটি কারাগারে গিয়েছিল কারণ তারা জানতে চেয়েছিল যে কীভাবে শ্রদ্ধানন্দের মতো একজন ব্যক্তি শকেরেহের মতো কাউকে প্রভাবিত করতে পারে।
” শুরুতে আমরাও তার কথায় প্রভাবিত হয়ে যাই। মনে হয়েছিল যে, এই গল্পের আরও অনেক স্তর রয়েছে, যদিও তার সাথে কথা শেষ করার পর আমাদের কারোই তার অপরাধ সংঘটনের বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিল না।”
তিনি বলেন, তারা ভেতরে খুব সতর্কতার সাথে যান। মানুষটি ছিলেন ছোটখাটো, ক্ষীণকায় ও বয়স্ক। কিন্তু আমরা গল্পটি সম্পর্কে যখন আরও বেশি জানতে পারি এবং তার সাথে আরও বেশি যোগাযোগ করতে থাকি আমাদের ততোই মনে হতে থাকে যে তার একটি এজেন্ডা আছে, তিনি আমাদের নিয়ে খেলছিলেন, আমাদের দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছিলেন”।
“আমরা তার সাথে যত বেশি সময় কাটিয়েছি, ততই আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তার অনুভূতি খাঁটি না, এবং শেষের দিকে আমরা তার সাথে আরও কঠিন কথাবার্তা বলার চেষ্টা করেছি,” গ্রাহাম বলেন।
এবং এ কারণে শ্রদ্ধানন্দের কাছ থেকে তাদের “কটূক্তি” শুনতে হয়। শ্রদ্ধানন্দ তাদেরকে “জোর দিয়ে বলছিলেন যে তিনি নির্দোষ, তার সাথে খারাপ আচরণ করা হচ্ছে”। বলেন গ্রাহাম।
বেশিরভাগ সত্যিকারের অপরাধভিত্তিক সিরিজে, একজন অপরাধীকে “প্রতিভাবান” হিসাবে সামনে আনা হয়। গ্রাহাম বলেন।
“কিন্তু আমি যে এমনটা চাইনি সে ব্যাপারে খুব পরিষ্কার ছিলাম। অবশ্যই শ্রদ্ধানন্দের কিছু গুন ছিল, তার মধ্যে একটি হল মানুষকে তার কথা বিশ্বাস করানোর ক্ষমতা,” তিনি বলেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারতীয় আদালতে তিনি নিজেকে নির্দোষ বলে বিশ্বাস করাতে পারেননি।